বর্ষাকালের নাম নিলেই চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে রিমঝিমাঝিম বৃষ্টির চিত্র। আমাদের দেশ ষঢ়ঋতুর দেশ। ছয়টি ঋতুর মধ্যে যার দাপট, যার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি সেটি হলো বর্ষাকাল। ‘আষাঢ়-শ্রাবণ’ এই দু’টি মাসে বর্ষাকালের সৃষ্টি। বর্ষাকাল মানেই ঝুমুরঝুমুর বৃষ্টি। অবশ্য বর্ষাকাল ছাড়াও বৃষ্টি হয়। তবে তার পরিমাণ খুবই কম।
বর্ষাকালে খালবিল, নদীনালা সবই থাকে টইটম্বুর। আমাদের জাতীয় ফুল শাপলাও এই বর্ষাকালেই ফোটে। শহর এবং গ্রামাঞ্চলে কেয়া-কদমের ছড়াছড়ি তখনই চোখে পড়ে। গাছগাছালি হয়ে ওঠে সজীব ও সতেজ। সারাদিন একটানা বৃষ্টির ঝরঝর শব্দ। সহসা ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে হয় না কারো। বর্ষাকাল মানেই যে কেবল বৃষ্টি তা কিন্তু নয়। বরং বর্ষাকালেও আকাশ মাঝেমধ্যে ফর্সা হয়ে যায়। বৃষ্টিও থেমে যায়। তখন মনে হয় ভারী বর্ষণের পর আকাশটা বোধহয় বিশ্রাম নিচ্ছে। তবে সে বিশ্রাম খুবই ক্ষণস্থায়ী হয়। আবার আকাশ মেঘলা হয়। আবার নেমে আসে বৃষ্টি।
বর্ষাকালে নানারকম ফুলের পাশাপাশি রকমারি ফলও পাওয়া যায়। গ্রীষ্মকালকে ফলের মৌসুম ধরা হলেও এর রেশ বর্ষাকাল অবধি বিস্তৃত হয়। বর্ষাকালে আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে। ফলের রাজা আমও পাওয়া যায়। আর জাতীয় মাছ ইলিশের কথা তো সকলেই জানি। ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ আসে এই বর্ষাতেই। জাতীয় পাখি দোয়েল তার মধুর সুরে শোনায় বর্ষার আগমনী গান। জাতীয় ফুল শাপলা বর্ষার পানি পেয়ে মুখ খুলে দেয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও বর্ষাকাল নিয়ে অনেক ছড়া-কবিতা ও গান রচনা করেছেন। তাঁর কবিতায় দেখতে বর্ষাকে দেখি এভাবে-
‘‘আজ যেন মেঘের মাথায়
আম জাম আর কাঁঠাল ছায়ায়
বর্ষার রূপ দেখ দু’চোখ ভরে
নদ-নদীতে বৃষ্টি খেলা করে।’’
বর্ষাকাল নিয়ে ছড়া, কবিতা ও গান লিখেছেন অনেক বড়ো বড়ো কবি-সাহিত্যিক। বলা যায় বর্ষা বা বৃষ্টি নিয়ে ছড়া বা কবিতা রচনা করেননি এমন কবি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমরা এখন সেইসব কবি সাহিত্যিকদের ছড়া, কবিতা ও গানের মাধ্যমে বর্ষাকে দেখবো আরো গভীরভাবে। রবীন্দ্রনাথের ছড়া, কবিতা ও গানে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের পাশাপাশি আকাশ মেঘলা ও নদ-নদীর চিত্রই বেশি ফুটে ওঠেছে। তাঁর ‘ছোট নদী’ কবিতাটির চার লাইন এরকম-
‘‘আষাঢ়ে বাদল নামে নদী ভরভর
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরখর
দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া
বর্ষার উৎসবে জেড়ে ওঠে পাড়া। ’’
কাজী নজরুলের কবিতা ও গানে ফুটে ওঠেছে বর্ষার সুনিপুণ চিত্র। তাঁর একটি সুপরিচিত গান-
‘‘রিমঝিম রিমঝিম ঐ নামিল দেয়া
শুনি শিহরে কদম, বিদরে কেয়া
ঝিলে শাপলা কমল
ঐ মেলিল দল
মেঘ অন্ধ গগণ, বন্ধ খেয়া। ’’
তাঁর আরেক গানে দেখা যায় এই বর্ষারই ভিন্নরূপ-
‘‘আদর গরগর
বাদর দরদর
এ থনু ডরডর
কাঁপিছে থরথর
নয়ন ঢলঢল
সজল ছলছল
কাজল কালোজল
ঝরলো ঝরঝর।’’
বর্ষার চিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে পল্লীকবি জসিম উদ্দীন লিখেছেন-
‘‘আসমানিদের গেহখানি ভেন্নাপাতার ছানি
একটুখানি বৃষ্টি হলে গড়িয়ে পড়ে পানি।’’
বৃষ্টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি ছড়াকবিতা বোধহয় লিখেছেন কবি ফররুখ আহমদ। বর্ষাকাল ও বৃষ্টি নিয়ে তাঁর রয়েছে দারুণ দারুণ সব ছড়া। বলা যায় বৃষ্টির ছড়াতে তিনি রাজমুকুট পরে আছেন। তাঁর চমৎকার কয়েকটি ছড়ার অংশবিশেষ নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
‘‘আকাশজুড়ে বেড়ায় উড়ে
মেঘ মেলে তার পাখনা
কচি-সবুজ মাটির চারা
খোলে মাটির ঢাকনা। ’’
কাশবন, বাঁশবন, ঘাসবন, বকের সারি আর নদনদী বর্ষায় কেমন রূপ ধারণ করে? ফররুখের ছড়াপাঠ না করে সে চিত্র কেমন করে পাওয়া যাবে। তিনি লিখেছেন-
‘‘বৃষ্টি এলো কাশবনে
জাগলো সাড়া ঘাসবনে
বকের সারি কোথারে
লুকিয়ে গেলো বাঁশবনে।
নদীতে নাই খেয়া যে
ডাকলো দূরে দেয়া যে
গাঁয়ের নামটি হাটখোলা
বৃষ্টিবাদল দেয় দোলা।’’
বর্ষার ওপর কবি ফররুখের লেখা একটি বিখ্যাত ছড়ার নাম ‘শ্রাবণের বৃষ্টি’। এ ছড়াটি পাঠ্যপুস্তকেও রয়েছে। ছড়াটির ছন্দে বৃষ্টির ফোঁটাগুলোরই প্রতিধ্বনি যেন শোনা যায় এভাবে-
‘‘বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর
বৃষ্টি নামে মিষ্টি মধুর
বৃষ্টি পড়ে ফোঁটায় ফোঁটায়
জুঁই চামেলী ফুলের বোঁটায়
বাদলা দিনের একটানা সুর
বৃষ্টি নামে ঝুমুরঝুমুর।’’
এভাবে বর্ষাকাল ও বৃষ্টি নিয়ে অনেক মজার মজার ও বাস্তবমুখি কবিতা ও ছড়া রচনা করেছেন বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকেরা। থেমে নেই বর্তমান সময়ের ছড়াকার-কবিরাও। প্রশ্ন জাগে, বর্ষা নিয়ে এত এত ছড়া, কবিতা বা গান কেন লেখা হয়? কেন লেখা হয়- লেখা হয় এ কারণেই, বর্ষা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঋতু। বর্ষার আগমণে গ্রামবাঙলার মানুষ আনন্দে মেতে ওঠে। উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি করে বর্ষার রিনিঝিনি বৃষ্টি। কৃষকের মুখে ফুটে ওঠে হাসির ঝিলিক। জেলেরা থৈ থৈ পানিতে মাছ ধরতে নামে। আবার এই বর্ষাই কখনো কখনো দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বন্যা ডেকে আনে বর্ষার প্রবল বর্ষণ। গোটা বাংলাদেশ তলিয়ে যায় পানির নিচে। বানবাসি মানুষ নৌকা ও বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়। গৃহপালিত জীব গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি ইত্যাদিও নৌকায় আশ্রয় নেয়। এসময় কষ্টের কোন সীমা থাকে না মানুষ এবং গৃহপালিত পশুপাখির। কতো মানুষ প্রাণ হারায়, কতো পশু পাখি মারা যায়। ফসলের ক্ষয়ক্ষতির তো কোন তুলনাই করা যায় না। অথচ বন্যা শেষ হলেই মানুষের মনে প্রাণচাঞ্চল্য শুরু হয়। আবার মানুষের মনে সৃষ্টি সুখের উল্লাস জাগে। ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিহলেও বর্ষা নিয়ে আসে সোনার পলিমাটি। ফসলের উৎপাদনও তাই বৃদ্ধি পায়।
এককথায় বলতে গেলে বলা যায় বর্ষাকাল বাংলাদেশকে নতুন করে সাজিয়ে দেয়। বর্ষাকাল না এলে গোটা দেশ শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত। তাই বর্ষাকাল আমাদের প্রয়োজন। আমরা তাই ভালোবাসি বর্ষাকালকে। ভালোবাসি বর্ষার অপরূপ সৃষ্টি রিমঝিম রিমঝিম বৃষ্টিকে। কবির ভাষায়-
‘‘বৃষ্টি আমার মন কেড়ে নেয়
টাপুরটুপুর সুর করে
বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা
দুঃখ-ব্যথা দূর করে।
বৃষ্টি আমার বুকের ভেতর
টাপুরটুপুর গান করে
বাংলাদেশের চিত্র দেখে
হৃদয়টা আনচান করে।
বৃষ্টি আমার ভালোবাসা
বৃষ্টি আমার পছন্দ
তাইতো গড়ি বৃষ্টি দিয়ে
কাব্যকথা ও-ছন্দ।’’
লেখক: ছড়াকার ও শিশুসাহিত্যিক, সম্পাদক- সোনার সিলেট ডটকম।
সোনার সিলেট/ তাহোতা
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
« Nov | ||||||
1 | ||||||
2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 |
9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 |
16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 |
23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 |
30 | 31 |