১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ সকাল ৬:৪৮

‘আবিররাঙা ভোরের হাসি’ কিশোর-মনে দোল খাওয়াবে

জহুর মুনিম
  • আপডেট শুক্রবার, জুন ৪, ২০২১,
ইয়ের নাম ‘আবিররাঙা ভোরের হাসি’ । কবি ভোরের সান্নিধ্যে গিয়েছেন। তখন ভোরকে হাসতে দেখেছেন৷ ভোরকে তিনি রাঙানো পেয়েছেন। আবিরের (এক প্রকার তরল পদার্থ, অন্য নাম ফাগ) রঙে রাঙানো। সেটি দিয়েছেন বইয়ের শিরোনাম। যা প্রকৃতির প্রতি তার মমতা বা প্রকৃতির কতটা কাছাকাছি তিনি গিয়েছেন, তার প্রতিনিধিত্ব করছে৷ বইটি খুললে এর আরও প্রমাণ মিলে। কেননা, সবচেয়ে বেশি যে বিষয় ওঠে এসেছে তার বইয়ে, তা প্রকৃতি। নানান ঢঙে তিনি প্রকৃতিকে দেখেছেন, দেখিয়েছেন।
বইটির ফ্ল্যাপ লিখেছেন শিশুসাহিত্যিক হাসনাত আমজাদ । শেষদিকে তিনি লিখেছেন, ‘আবিররাঙা ভোরের হাসি তোরাব আল হাবিবের সেই গ্রন্থ যার প্রতিটি পাতায় রয়েছে মন ভালো করা কিশোর কবিতা, মন ছুঁয়ে যাওয়া এমন কিছু ছোটদের কবিতা যা শুধু কিশোরদের নয়, বড়দের মনেও দোলা লাগাবে’।
হাসনাত আমজাদ এর এ কথার সত্যতা নির্ণয় করতে খুব বেশি দূর যেতে হয়নি৷ বরং প্রথম কবিতায় আছে তার প্রমাণ। দেখা যাক প্রথম কবিতাটি—
শিরোনাম ‘স্বদেশ আমার সোনার মোহর’। নামে বিস্ময়! স্বদেশ কীভাবে সোনার মোহর হলো? দেশে এমন কীসের উপস্থিতি তিনি উপলব্ধি করলেন যে, উপমা দিলেন সোনার মোহর এর সাথে। আচ্ছা তাহলে এগুনো যাক।
কবিতাটিতে কবি দেশকে তুলে ধরেছেন বললেও মূলত গ্রাম বেশি ফুটে ওঠেছে। কেননা কবিতায় যা যা এনেছেন, তা গ্রামেই উপস্থিত।
শুরু করেছেন এভাবে—
ফুল পাখি লতাপাতা ভরা এই দেশ
চারদিকে মায়াময়
বিছানো আবেশ
অর্থাৎ সাধারণভাবে প্রথমেই দেশের একটি পরিচয় দিয়েছেন খুবই মায়াভরা কথায়৷ যা পাঠককে দীর্ঘ কবিতার শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাবে। এরপর নদী, পাহাড়, ঘাস সবার কাছে গিয়েছেন৷ কে কী করছে, তা বলছেন। যেমন বলছেন—
নদীগুলো ঢেউ তুলে নিরবধি বয়
ভাটিয়ালি তাল-সুর কী যে মধুময়
ঝিরিঝিরি বাতাসের
কানে বাজে গান
পুকুরের জলে ওঠে ঢেউ কলতান।
এরপর আরও বলছেন—
বেতসের ঝোপে থাকে আর নল আর খাগ
রাঙা ঠোঁটে হেসে ওঠে
কলমি-পরাগ
কদমের ডালে বাঁধে ঘুঘুপাখি নীড়
সকালের সুয্যিটা ছড়ায় আবির
ফুলে ফুলে চুমো দেয়
কত মধুকর
আমাদের দেশ যেন সোনার মোহর।
এতটুক পড়ার পর হাসনাত আমজাদের সেই কথার সত্যতা পাই। কী এক মায়ায় যেন জড়িয়ে যাই! কবিতাটি তাই আবার পড়ি। আবার পড়ি। বারবার পড়ি। পরিস্কার হয় এটাও যে, কেন সোনার মোহর এর সাথে উপমা দিয়েছেন দেশকে৷
কবিতাটিতে আরও একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, সচরাচর প্রকৃতি নিয়ে এমন লেখা দেখা যায় না৷ যা লেখা হয়, সেসবে তেমন নতুনত্ব থাকে না। এই কবিতাটি পড়ে একজন শহরে বেড়া ওঠা কিশোরের মনে প্রশ্ন ঝমবে, বেতস কী? নল আর খাগই বা কী?
সুতরাং কবি যে এই কবিতার মধ্য দিয়ে গ্রাম-বিচ্ছিন্ন মানুষদের গ্রামের সাথে একটা বন্ধন তৈরি করবেন, সে বিষয়ে সন্ধেহ নেই।
যেতে যেতে কবিতার শেষ অংশ পড়ুন—
থানকুনি-পুঁইশাকে ভরা চারিদিক
নদীতীরে বালুকণা
করে চিকচিক
লটকন আমলকি সুপারি ও পান
হলুদাভ হয়ে ওঠে কাঁঠাল বাগান
দুটি চোখ ভরে যায়
দেখে পরিবেশ
পৃথিবীর সেরা সে যে আমাদের দেশ।
‘সবুজ গাঁয়ের পরশ’ বইয়ের দ্বিতীয় কবিতার শিরোনাম। শুরুতেই কয়েকটি সরল শব্দে গ্রামের সর্বোচ্চ সৌন্দর্য তুলে ধরা হয়েছে৷ কবি বলছেন—
ছবির মতো গ্রামটা আমার
গ্রামের মতো ছবি
কোনোকিছুকে কখন ছবির সাথে তুলনা দেওয়া হয়? যখন তা অকল্পনীয় সুন্দর হয়৷ কারণ শিল্পী একটি ছবি যেভাবে ইচ্ছে এঁকে সৌন্দর্য বাড়াতে পারেন। সুতরাং কবি গ্রামকে ছবির সাথে তুলনা দিয়ে বুঝালেন যে, তাঁর গ্রাম অবর্ণণীয় সুন্দর।
এরপর ছবির সাথে কেন তুলনা করেছেন, তা বলেছেন পুরো কবিতাজুড়ে। কবি বলতে শুরু করেছেন—
ছবির মতো গ্রামটা আমার
গ্রামের মতো ছবি
বাঁশঝাড়ের অই ফাঁকফোকরে ওঠে প্রভাত-রবি।
দোয়েল ডাকে সদলবলে টুনটুনি গায় গান
মুর্তাবেতের শীতলপাটি
মায়ের অবদান।
গ্রাম নিয়ে যত লেখালেখি হয়, সেসবে সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ হয়তো সেই লেখক শুধু গাছ আর পাখি নিয়ে লিখেন, বা পুকুর আর মক্তব নিয়ে লিখেন৷ কিন্তু কবি তোরাব আল হাবিব হাঁটলেন নতুন পথে। টের পেলেন গ্রাম নিয়ে আরও অনেককিছু লেখার আছে। তাই তুলে আনলেন গ্রামের সেসব সৌন্দর্য, যেগুলো নিয়ে অন্য লেখকগন লেখার প্রয়োজন মনে করেননি বা সেগুলো এড়িয়ে গেছেন। কবি বলছেন—
কদম ডালে ঘুঘুর বাসা
জারুল গাছে ফিঙে
উঠোনজুড়ে শিমের মাচা নয়ন জুড়ায় ঝিঙে।
বাড়ির পাশে সর্ষে ক্ষেতে হলুদ ফুলের হাসি
তাল-গুবাকের আকাশ ছোঁয়া
দৃশ্য অবিনাশী।
বিল-বাঁওড়ে বেষ্টিত গাঁ
লতায়-পাতায় ঘেরা
আলোর পিদিম দেয় জ্বালিয়ে রাতের জোনাকেরা।
দূর্বাঘাসের সবুজ চাদর চতুর্দিকেই পোঁতা
পাখপাখালি গাছগাছালির
নিবিড় সমঝোতা।
কবি গাঁয়ের প্রকৃতি নিয়ে ভাবার সাথে সাথে ভাবেন গাঁয়ের সরল-সহজ মানুষদের নিয়ে৷ তাই তাঁর লেখায় সহজে ওঠে আসে—
রাখাল ছেলে গরু নিয়ে
যায় সে দূরের মাঠে
সাঁঝের বেলা বাড়ি ফেরে সূর্য গেলে পাটে।
নদীর বুকে পালতোলা নাও, দাঁড় বেয়ে যায় মাঝি
কৃষক তোলে বৈশাখি ধান
রেখে জীবনবাজি।
গ্রাম মানুষকে কবি বানাতে পারে। গ্রাম পারে মানুষকে শুদ্ধ সুন্দর করতে। কবিতার শেষে কবি সেটাই বলছেন—
ঢোলকলম আর কলমিলতা
কেয়া চাপার গন্ধে
বিরস এ মন চনমনে হয় মাতে ছড়ার ছন্দে।
ভোরের বাতাস স্নিগ্ধ সতেজ মন করে দেয় সরস
যে পেয়েছে এমনতর
সবুজ গাঁয়ের পরশ ।
পরের কবিতার শিরোনাম ‘ফুল’ । ফুল যখন কারও লেখার বিষয় হয়, তখন তাতে প্রেম থাকে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কবি এক্ষেত্রে দৃষ্টিকে বিস্তৃত করেছেন। ফুল যে কারও দুঃখেরও কারণ হয়, তা বলছেন শুরুর দিকে—
ফুল মানুষকে আনন্দ দেয়
ফুল মানুষকে হাসায়
ফুল কখনও শোকের জলে—দুখের নদে ভাসায়
ফুল মানুষকে স্বপ্ন দেখায়
ফুল করে দেয় নিঃস্ব
বলতে গেলে ফুলের প্রেমে নতজানু বিশ্ব ।
এতটুক পড়ার পর আপনি ভাববেন, ফুল আবার মানুষকে শোক জলে ভাসায় কীভাবে? ফুল স্বপ্ন দেখানোর মতো বড় কাজ কীভাবে করতে পারে? কীভাবেই বা ফুল মানুষকে নিঃস্ব করে?
এরকম ভাবনায় কবি পাঠককে রেখেছেন কবিতার শেষ পর্যন্ত। কবিতাটি পড়লে পাঠক যেভাবে ভাবনার সাগরে ডুববেন, সেভাবে ভালোলাগার হাওয়ায় দোল খাবেন। কবিতার আরও এক স্তবক শুনানোর লোভ সামলাতে পারছি না—
ফুল মানুষকে কথা শেখায়
ফুলের আছে দন্ত
ফুলের ভেতর জমা থাকে মধু অফুরন্ত
ফুলের আছে চক্ষু ও ঠোঁট
ফুলের আছে কর্ণ
ফুলের আছে বুকের ভেতর সকল ভাষার বর্ণ।
কবিতাটি পড়ে পাঠক ফুল নিয়ে ভাববে। ফুলের প্রতি তৈরি হবে এতোই আগ্রহ, তখন তোরাব আল হাবিবের পাঠকসমাজ হয়ে যেতে পারে ফুল-গবেষক !
ফুল এর পরের কবিতা ‘উড়াল’ ৷ কবি উড়াল দিয়েছেন স্বপ্নে। মানুষ স্বপ্নে কত কী করে। কবি স্বপ্নে উড়েছেন। উড়ার গল্প শুনিয়েছেন পুরো কবিতায়। শুরু এরকম—
ঘুম ছাড়ে না ঘুম ছাড়ে না
চক্ষু ঢুলুঢুলু
ঘুমের ঘোরে যাচ্ছি উড়ে হাওয়াই হনুলুলু।
পঙ্খিরাজে যাচ্ছি চড়ে
থামছি না তো বৃষ্টি ঝড়ে
যাচ্ছি উড়ে ঢাকা থেকে ওই সুদূরের পেরু
স্বপ্নযোগে দেখছি একা বিচিত্র সব মেরু।
সুন্দর শব্দচয়নের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে দেখিয়েছেন অন্ত্যমিলের খেল।
মুগ্ধ না হয়ে পারি না, যখন বলেন—
ফল-ফলাদির বন পেরিয়ে
তাড়াহুড়োর ক্ষণ পেরিয়ে
বা যখন বলেন—
যাচ্ছি উড়ে ফুলের দেশে
দুধেলসাদা চুলের দেশে
আরও মুগ্ধ হই, যখন বলেন—
উড়ছি আমি ঘুড়ির মতো
চরকাকাটা বুড়ির মতো
সাধারণ স্বপ্নকে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করার এ চেষ্টা অনুভব করে পাঠকমাত্রই মুগ্ধ হবে।
পঞ্চম কবিতা ‘ষোলোই ডিসেম্বর’ ৷ আমরা যখন দেখলাম একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বরে আনন্দের হাসি ফুটেছে বাঙলাদেশের মুখে ৷ যখন দেখলাম হাসি ফুটেছে সকল বাঙালির মন ও মুখে, কবি তখন দেখলেন অন্যকিছু। দেখলেন বিজয়ের আনন্দে হাসছে পাখি, হাসছে গাছের পাতা, নদী, ফুলও । কবি তখন হেসে হেসে লিখে ফেললেন একটি দীর্ঘ কবিতা। যার শুরু এরকম—
উঠলো হেসে ডালের পাখি উঠলো হেসে পাতা
উঠলো হেসে বাগানভরা ফুল
উঠলো হেসে নদীর দু’টি কূল
উঠলো হেসে খুকুর তুলি, উঠলো হেসে খাতা
উঠলো হেসে দূর আকাশের চাঁদ
মায়ের কোলে উঠলো হেসে বাঁধভাঙা আহ্লাদ ।
চমৎকার কবিতাটি শেষ করার পর পাঠক পড়বে ‘শীতের বাহক’ কবিতাটি৷ যা বইয়ের ষষ্ঠ কবিতা। কবিতায় শরৎ-ঋতুর কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কবি মোহনীয় এই ঋতুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন কবিতায়। শুরুতে বলছেন—
একসকালে শরৎ এসে
ঠোঁট বাঁকিয়ে ডাকলো
নদীর ধারে দোলখেলানো কাশের ছবি আঁকলো
বানে আসা বালুর ঢিবি
সবুজে ঘাস ঢাকলো।
শরৎকালে কখনও কখনও বৃষ্টি হয়। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি৷ আবার স্বচ্ছ হয়ে যায় আকাশ৷
বৃষ্টি-রোদের এ লুকোচুরি মুগ্ধ করে যে কোনো কবিকে। এই কবিও মুগ্ধ হয়েছেন। তাইতো লিখে ফেললেন—
আকাশজুড়ে মেঘের মিছিল
এদিক ওদিক ছুটলো
ডালে ডালে পাতায় পাতায় জুঁই-কামিনী ফুটলো
বর্ষা ভুলে মেঘ ছাপিয়ে
সূর্য হেসে উঠলো।
শরৎ যখন হাসে, যখন আকাশে
মেঘ উঁকিঝুঁকি দেয়, শরতের হাওয়ায় যখন দোল খায় দিগন্ত-বিস্তৃত রোপা আমন ধানের সবুজ ক্ষেত, তখন কবির অন্তরে প্রকৃতিপ্রেম যেন আরও বাড়ে৷ তিনি লিখেন—
একসকালে শরৎ এসে
খিলখিলিয়ে হাসলো
পেঁজামেঘের জমাট দলা শূন্য হাওয়ায় ভাসলো
আমন ধানের সবুজ রোপন
মাঠে চাষি চাষলো।
শরৎপ্রেমি কবির এই কবিতাটির প্রেমে পড়তে পারে খোদ শরৎও !
সপ্তম কবিতা ‘সেই স্মৃতি সেই ক্ষণ’ ৷ মানুষ বড় হয়, কিন্তু শৈশব ভুলে না ৷ সাধারণ হলে শৈশবের স্মৃতি বলে মুখে, আর কবি হলে লেখায়। তাইতো কবি ফেলে আসা শৈশবকে স্মরণ করতে রচনা করলেন কবিতা, বেশ দীর্ঘ । শুরুর দিক থেকে কিছুটা পড়া যেতে পারে—
আমগাছ জামগাছ বেতসের ঝোপ
ডালে ডালে পাখিদের নিরাপদ খোপ।
ঘুঘু আর শালিকের সাথে ছিল প্রেম
সবুজাভ শৈশব চির মোলায়েম।
জীবনটা ছিল এক
ফড়িঙের ডানা
হেসেখেলে বেড়িয়েছি
ছিল নাতো মানা।
কবিতাটিতে কবি বিচরণ করেছেন শৈশবে। বা কবিতাটি বিচরণ করেছে কবির শৈশবে! শৈশব-স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে শেষ করেছেন কবিতা। যেতে যেতে জানিয়েছেন, তিনি শৈশবকে ভালোবাসেন। ভালোবাসেন শৈশবের প্রতিটা মুহুর্তকে ।
রাখালের মোহনীয় বাঁশিটার সুর
দুপুরের ঝলমলে আলো রোদ্দুর।
মাঝনদী বরাবর পালতোলা নাও
পেছনে সে ফেলে আসা ছোটপাড়া গাঁও।
চাষিদের ছাতা মাথা
কিষানের হাসি
সেই স্মৃতি সেই ক্ষণ
আজো ভালোবাসি।
পরের কবিতা ‘আজব ছুটি’ । করোনায় সবাই যখন ছুটি পেয়েছিলো, তখন থাকতে হয়েছিলো ঘরে৷ অন্য যেকোনো ছুটির চেয়ে এ ছুটি ছিলো আলাদা। কোথাও বেড়াতে যাওয়া মানা, এমনকি ঘরের বাইরে যাওয়াও ৷ কিশোর-মনের কষ্ট বুঝেছিলেন কবি । সেটাই বললেন কবিতায়। শুরুর দিকটাই পড়ুন না !—
এই ছুটিতে আনন্দ নেই এই ছুটিতে কষ্ট
এই ছুটিতে মনগহনে বিষাদ বাড়ায় পষ্ট
এই ছুটি তো সঙ্গত্যাগি এই ছুটি তো শাপ
এই ছুটিতে দিবসযামী বাড়ায় মনস্তাপ
এই ছুটিতে স্বপ্ন ভাঙে মন ভেঙে হয় চুর
এই ছুটিতে দল বেঁধে তো কেউ করে না ট্যুর।
শুধু কি কিশোররা এ যাতনা টের পেয়েছিলো? না, বরং বাঙলাদেশের সবাই ছিলো বিপদে! কবি সেটাও বুঝেছেন ৷ তাই তো কবিতার শেষে সেটা বলেছেন এবং চেয়েছেন করোনার হাত থেকে মুক্তি । —
অদ্ভুত এক ছুটি নিয়ে আমরা আছি বন্দি
এমন ছুটির যায় না পাওয়া আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী
ছুটি নিয়ে এই বাঙালি পড়ছে ভীষণ ফান্দে
একলা একা ঘরের ভেতর ছুটির জ্বালায় কান্দে।ওহে ছুটি দাও না বিদায় বাড়াসনে দিন আর
মন থেকে চাই ধ্বংস কেবল নোভেল করোনার।
পরের কবিতার শিরোনাম ‘প্রতিস্থাপন’ ৷ গম্ভীর শিরোনাম। বাহ্যিক দৃষ্টিতে কবিতার সাথে শিরোনামের মিল না পাওয়া গেলেও কবিতাটি পড়ে আমি একটি মিল দাঁড় করিয়েছি ৷ সুক্ষ্ম-মিল। কবিতায় কবি কী কী হারিয়ে গেছে, তার একটা বর্ণনা দিয়েছেন৷ কবিতার শেষ লাইনে হতাশ-কন্ঠে বলছেন—
জায়গা করে নিচ্ছে কেবল
হাজার অসঙ্গতি
বুঝা যাচ্ছে যে, কবি যথেষ্ট হতাশ এ কারণে যে, কেন সেগুলো হারালো, আর কেন সেগুলোর জায়গা জুড়লো অসঙ্গতি ৷ তাই কবি যা যা হারিয়েছে, সেগুলো যে আবার ফিরে পেতে চান, শিরোনাম ‘প্রতিস্থাপন’ দিয়ে এককথায় হয়তো সেটাই বুঝাতে চেয়েছেন । কবিতার শেষদিক এরকম—
হারিয়ে গেছে বৌচি খেলা
দখিনমাঠে ষাঁড়ের মেলা
হারিয়ে গেছে গোল্লাছুটের গোল্লা
হারিয়ে গেছে আদব-লেহাজ
আর খাঁটি সব মোল্লা ।
হারিয়ে গেছে বনের ঝিঁঝি
নীলাভ প্রজাপতি
জায়গা করে নিচ্ছে কেবল
হাজার অসঙ্গতি।
‘ডাক’ দশম কবিতা । কবিতায় কবি তাদেরকে জাগাচ্ছেন, যারা ভোর কাটায় ঘুমে৷
শুরুতে বলছেন—
হাত বাড়িয়ে ভোরের বাতাস ডাকে
বোকানদীর বাঁকে
ঘুমের ঘোরে আর থেকো না
আর রেখো না বন্ধ সকল দোর
ডাকছে তোমায় কোমল বায়ের কুঞ্জ-কূজন ভোর।
এখানেই শেষ নয়। কী দরদী ভাষায় ভোরের উপকারিতা বলছেন, যেন সবাই ঘুম থেকে জাগতে উৎসাহ পায়। কবি বলছেন—
ভোরের ছবি রোদ ছড়িয়ে ডাকে
চিরলপাতার ফাঁকে
ভোরের রোদে দাওয়াই আছে
বালিশ ছেড়ে ওঠো
দূর্বাঘাসের মেঠোপথে জোরকদমে ছোটো
ভোরবেলাতে যায় পাওয়া যায়
নির্ভেজাল এক বায়ু
সেই বায়ুতে হাঁটলে পরে বাড়ে নিরোগ আয়ু
স্নিগ্ধ বাতাস স্নিগ্ধ আলো স্নিগ্ধ শিশিরকণা
প্রত্যুষে দেয় ধুয়ে মুছে মনের আবর্জনা ।
ভোরে অনেকেই ঘুমে থাকে, তাই বলে সব কাজ তো থেমে থাকে না ৷ তখনও পৃথিবী চলে তার গতিতে। কাজের মানুষ লেগে যায় কাজে। বরং ভোর অন্য সময়ের চেয়ে বেশি সুন্দর। কবিতার শেষদিকে এগুলোই বলা হচ্ছে—
ডাকছে নদী ছলাৎ-ছলাৎ সুরে
যেতে সমুদ্দুরে
নৌকা চলে ভাটির দেশে
গায় মাঝিরা গান
জলের ধারা কানে বাজায় মধুর কলতান
ভোরের মাঝি ভোরের কিষাণ ডাকে
দেখতে আকাশটাকে
নীলাভ আকাশ ফটিক নদী
নির্মলতায় ভরা
ভোরবেলাতে জাগলে তবে জাগবে বসুন্ধরা।
পরের কবিতা ‘কলমের আওয়াজ’ । লেখকদের মনে নতুন লেখা সৃষ্টির একটা ইচ্ছে সবসময়ই কাজ করে। তবে সেটা সম্ভব হয় না সকল সময় । এই বাস্তবতাই উপস্থাপিত হয়েছে কবিতায়।
কতকিছু নিয়ে লেখার ইচ্ছে জাগে৷ প্রায়ই লেখার বিষয় বা মোটামুটি একটা চিত্র এসেও যায় মাথায়। কিন্তু সেটা আর লেখা হয়ে ওঠে না। লেখতে মন চায় নদী নিয়ে, আকাশ নিয়ে, পাহাড় নিয়ে। কবিতায় এসেছে এ বিষয়গুলোও। শুরু এরকম—
তারিখ করেই দিন পেরিয়ে মাস চলে যায়
হয় না তারিখ শেষ
চলছে জীবন বেশ
নদী নিয়ে লিখবো আমি একটা দারুণ ছড়া
জানবে বসুন্ধরা
সেই নদীতে থাকবে পানি কানায় কানায় ভরা।
পুরো কবিতায় কবি লেখক-মনের দুঃখ বলে কারণটা শেষে বলছেন এভাবে—
মনের ভেতর অনেক বিষয় মোচড় মারে
লিখতে করে জোর
রাত্রি থেকে ভোর
কর্ম আমায় দেয় না ছুটি দেয় না অবসর
ব্যস্ত নিরন্তর
মনগহনে কলমটা দেয় আওয়াজ সমস্বর ।
‘রেখে এলাম’ পরের কবিতার শিরোনাম । মানুষ বড় হলে পেছনে রেখে আসে শৈশব। রেখে আসে শৈশব-স্মৃতিও। কিন্তু সেই শৈশবকে বা শৈশব-স্মৃতিকে ভুলা যায় না। মাঝেমধ্যেই স্মৃতিচারণ করা হয়।
ছোটবেলার দিনগুলো কাটে হাডুডু বা ফুটবল খেলে৷ সময় পার হয় নদীর সাথে মাখামাখি করে, কিংবা ফুলের সাথে মাখামাখি করে, বা পাখির সাথে। বড় হওয়ার পর শৈশব রেখে আসতে হয় পেছনেই। কবিতায় এসবই উপস্থাপন করা হয়েছে। শুরুতে বলছেন—
ছোট্টোবেলা রেখে এলাম নদীর ধারে কাশবাগানে
ঝিঁঝি ডাকা গাঁয়ের নিঝুম গহীন বনও বাঁশবাগানে
ছোট্টোবেলা রেখে এলাম হরেকরকম ঘুড়ির ডানায়
বক-শালিক আর দোয়েল-ঘুঘুর নিপুণ ওড়াওড়ির ডানায়।
যে গ্রামের সাথে এতো-এতো স্মৃতি থাকে, প্রয়োজনে কখনও সেই গ্রামই ছাড়তে হয় । গ্রাম হারিয়ে ফেলে আনন্দ, আনন্দ হারান গ্রামে থাকা মা । কবিতা শেষ করছেন এসবই বলে—
ছোট্টবেলা রেখে এলাম বাঁশের সাঁকো ছনের ঘরে
মিছেমিছি চড়ুইভাতি খড়বিচালি বনের ঘরে
ছোট্টবেলা রেখে এলাম স্নেহভরা মায়ের কোলে
পাখপাখালি পুষ্পেভরা চোখজুড়ানো গাঁয়ের কোলে।
কবিতাটির শোভা বাড়াতে সাহায্য করেছে সুন্দর অন্ত্যমিল। কাশবাগানে/বাঁশবাগানে । ছনের ঘরে/বনের ঘরে । এরকম অন্ত্যমিল যে চমৎকারিত্বের দাবী রাখে, সেটা বুঝতে সচেতন পাঠক হতে হবে, এরকম শর্ত জুড়ে দেওয়াও নির্বুদ্ধিতা !
‘মনের ভেতর’ তেরোতম কবিতা । কবিতায় একজন কবির মনের ভাবনাকে তুলে ধরা হয়েছে৷ একজন কবি কখনও মনের চোখ দিয়ে দেখেন একটা পাখি ওড়ে যাচ্ছে আকাশে৷ আবার দেখেন আকাশের চাঁদ, যা পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করেছে৷ আরও অনেক ভাবনা যে কবি-মনে আসে, সেটাই বলা হয়েছে কবিতায়। তবে কবিতায় যেভাবে কবি-মনের ভাবনাকে উপস্থাপন করার সম্ভাবনা আছে, ঠিক সেরকম সম্ভাবনা আছে কিশোর-মনের ভাবনাকে তুলে ধরার। কেননা একজন কিশোর মানেই ভীষণ আগ্রহী। সে অনেক কিছু নিয়ে ভাবে। তাই হতে পারে কবি কবিতাটিতে কিশোর-মনের ভাবনাকেই তুলে ধরেছেন। কবিতার শুরুর দিক থেকে কিছুটা পড়লে ব্যপারটা পরিস্কার হবে—
যখন যেমন ভাবনা আসে লিখতে থাকি লেখায় আসে জোশ
মনখারাপের দিনেও থাকে মনটা আমার ভীষণরকম খোশ
আমার ভেতর পাখি ওড়ে দেয় পাখিরা শিস
মনবাগানে সুবাস ছড়ায় গোলাপ অহর্নিশ
ভাসি আমি উজান-ভাটি দুলকি চালে নৌকা চলে, আহ!
আমার চলন বলন দেখে খুশির তোড়ে পড়শীরা কয়, বাহ্! ।
পরের কবিতা ‘মন হতে চায়’ । শিশুর মন কতকিছু হতে চায়! হতে চায় বড়দের মনও ৷ কেউ কেউ বুড়ো হলেও মন থেকে যায় শিশুর মতো । তাই বলা চলে এই কবিতাটি পড়ে সবাই সমানভাবে আনন্দ পাবে ৷ শুরুতে বলছেন—
মন হতে চায় উড়াল দেয়া পাখি
নীলের সাথে যখন-তখন করতে মাখামাখি
মন হতে চায় জারুল-হিজল
দূর্বাঘাসের ছোট্ট রঙিন দুল
মন হতে চায় রক্তজবা-সূর্যমুখী ফুল ।
কবিতাজুড়ে মন কী কী হতে চায় তা বলেছেন। যেমন বলেছেন মন চায় ঘুড়ি হতে, মন চায় প্রজাপতি হতে, নাটাই-সুতো হতে, শুভ্রমেঘের দল হতে । একেবারে শেষে কবি বলছেন, মন রবি-শশী হতে চায়, যাতে রাতের কালো দূর করা যায় । বাহ্যিক অর্থে আলো-অন্ধকার বুঝা গেলেও কবি এখানে সমাজ থেকে সকল অনিয়ম আর অন্যায়-অবিচার দূর করে একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে রবি-শশীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চান । শেষাংশ পড়া উচিৎ—
মন হতে চায় সবুজবনের ঝোপ
ডালে ডালে ঝুলতে থাকা বাবুইপাখির খোপ
মন হতে চায় রবি-শশী
রাতের কালো করতে বিনাশ ঠিক
এই পৃথিবী আলোর রেখায় ভরতে চতুর্দিক৷
‘বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের কবিতাটি পনেরোতম। আমরা বঙ্গবন্ধুকে বলি বাংলাদেশের বন্ধু, বা বলি বাঙালি জাতির বন্ধু ৷ কিন্তু কবিতায় কবি বঙ্গবন্ধুকে দেখাচ্ছেন আরও গভীর দৃষ্টিতে। কবি বলছেন, বঙ্গবন্ধু ফুলের বন্ধু, সাগর-নদীর বন্ধু, ঘুড়ির বন্ধু ৷ বঙ্গবন্ধু ফুল-ঘুড়ি ভালোবাসতেন ৷ ফুল-ঘুড়িও বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসে । কবিতার শুরুর দিকটা পড়ে আসি—
ফুলের বন্ধু পাখির বন্ধু
বন্ধু তিনি ঘুড়ির
ঝিনুক-প্রবাল, বালুর বন্ধু, বন্ধু পাথর নুড়ির
বন্ধু তিনি যুবক-শিশুর
বন্ধু বুড়ো-বুড়ির।
বঙ্গবন্ধু ও বাঙলাদেশ একই দেহ, সুতরাং বাঙলাদেশের যা, মুজিবুরের বন্ধুও তা! কবি এটা জানান দিয়েছেন ভালোভাবেই।
পরেই আছে ‘মনোহর পৃথিবী’ শিরোনামের কবিতা। কবি পৃথিবীকে দেখছেন, দেখছেন খুবই গভীর দৃষ্টিতে । আকাশ দেখে নিজেকেই আকাশ ভাবছেন । পাখিদের ওড়তে দেখলে নিজেকেও পাখি ভাবছেন । যেই কবি এতো গভীরভাবে পৃথিবীকে দেখেন, সে কবি পড়ে যান পৃথিবীর প্রেমে, আর তাঁর কবিতার শিরোনাম অবশ্যই হয় ‘মনোহর পৃথিবী’। পাঠক সে কবিতা পড়েন গভীর আগ্রহে—
আকাশের ছবি দেখে হয়ে যাই নীল
রাত্রির তারা দেখে হই ঝিলমিল
সবুজের সমারোহে হই একাকার
দুপুরের রোদ ডাকে খুলে তার দ্বার ।
চমৎকার এ কবিতার পরে আছে ‘সন্ধানী চোখ’ কবিতা ৷ আলোচনার শুরুর দিকে আমি বলেছিলাম, বইয়ে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি উঠে এসে, তা প্রকৃতি। ‘সন্ধানী চোখ’ কবিতাটি আরও একবার সে কথাটি মনে করিয়ে দেয়। কেননা কবিতাটি পড়ে কবি প্রকৃতির কতটা কাছাকাছি গিয়েছেন, তার প্রমান মিলে। গোলগাল একটি সূর্যকে তিনি কী দারুণভাবেই উপস্থাপন করলেন দেখুন—
সকালবেলার সূর্যে থাকে সিঁদুরমাখা লাল
রাগের মাথায় রোদ ছড়িয়ে ফোলায় দুটি গাল।
বিকেল হলেই এই দিবাকর নেয় হলুদে রূপ
পাখপাখালি ফিরলে নীড়ে হয় পরিবেশ চুপ।
কবিতার শেষে কবি যে প্রকৃতিপ্রেমি, সেটা নিজেই বলছেন—
জারুলগাছের শীতল ছায়া বেগুনি তার ফুল
একই রকম ফুল সমাহার চিনতে যে হয় ভুল।
ফুল-ফসলও বনবনানী দেখার ভীষণ ঝোঁক
দিন-রজনী খুঁজে বেড়ায় সন্ধানী এই চোখ।
’মন’, আঠারতম কবিতা। কবিতাটি মানুষের মন নিয়ে লেখা। মন মানুষের নিজের হলেও মনের মালিক ব্যক্তি নয়। কারণ মন কখনও ব্যক্তির ইচ্ছায় ভাবনার জগতে হারায়, কখনও বা ব্যক্তির অনিচ্ছায়৷ আর যে মন পড়ে কোনো কবির পাল্লায়, সে মনের তো রক্ষে নেই। প্রকৃতিপ্রেমি কবি তোরাব আল হাবিব তাঁর চঞ্চল মনের চঞ্চলতা বলেছেন কবিতাটিতে—
মন থাকে দূরে আর মন থাকে কাছে
বাবলার ডালে থাকে
থাকে তালগাছে
বাতাসের গতিটতি হার মানে হার
নিমিষেই খোলে যায় মনের দুয়ার
মন যায় টেকনাফে যায় তেঁতুলিয়া
এই যায় আমরিকা
এই মালেশিয়া।
মনকে বেঁধে রাখার শক্তি (সম্ভবত ইচ্ছেও) হয়তো কবির নেই, কিন্তু সেই মন কী কী চায়, কোথায় কোথায় যায়, সে কঠিন ব্যপারটিকে ধরে হেলতে-দুলতে উপস্থাপন করার দক্ষতা এই কবির আছে।
উনিশতম কবিতা ‘আমি’। কবিতাটি আমি বলব টক-ঝাল-মিষ্টি। বলার কারণও আছে৷ কয়েকটি লাইন নিছক মজার মতো। যেমন—
আমি চাল আমি ডাল আমি চিনি চূর্ণ
আবার কয়েকটি লাইনের গভীরতা অনেক ৷ যেমন—
আমি চাঁদ আমি আলো আমি তারা-সূর্য
বা—
আমি কবি আমি ছবি আমি ছড়া-কাব্য
পাঠকেরা গভীরতা ভেবেই ক্ষান্ত হবেন না, বরং কবিতাটি ঝাঁঝালো গলায় আবৃত্তিও করবেন।
দেখতে চান? শেষ চার লাইন ঝাঁঝালো গলায় আবৃত্তি করে দেখুন কেমন মানায়! —
আমি কবি আমি ছবি আমি ছড়া-কাব্য
আমি জল আমি ঢেউ আমি নদী-নাব্য
আমি গুণী আমি মুনি আমি সাধু-সভ্য
আমি আজ আমি গত আমি ভবিতব্য।
কবিতাটি ভিন্ন-স্বাদের। ছোট থেকে বুড়ো; সবাই কবিতাটির স্বাদ তো পাবেই, কিছুকিছু লাইন মাঝেমধ্যে অজান্তেই আওড়াবে।
পরের কবিতা ‘বিজয়ের দিন’৷ কবিতাটি ভালোভাবে পড়লে ‘ষোলোই ডিসেম্বর’ শিরোনামের কবিতার সাথে একটা অর্থগত মিল টের পাবেন পাঠক। ‘ষোলোই ডিসেম্বর’ কবিতায় বিস্তৃত দৃষ্টি দিয়ে যেভাবে মানুষের সাথে সাথে কবি তাঁর চারপাশকে হাসতে বা আনন্দিত হতে দেখেছিলেন, বিজয়ের দিন কবিতায়ও চারপাশকে আনন্দিত হতে দেখেছেন। তবে অন্য সবদিক থেকেই উভয় কবিতা সম্পূর্ণ আলাদা।
শুরু এরকম—
কোকিলের গানে আজ সুমধুর সুর
আকাশের গায়ে নেই একদলা মেঘ
ময়ুরের ডানাজুড়ে খুশির সিঁদুর
চারদিকে বিরাজিত জয়ের আবেগ।
কী চমৎকার শব্দচয়ন ও বর্ণনা পদ্ধতি ! পাঠক বিমোহিত না হয়ে উপায় নেই ।
অকল্পনীয় সুন্দর এই কবিতার শেষ পড়ুন—
তালবন শালবন ঝাউবন আর
আনন্দে ফেটে পড়ে মোটকু-বারিক
আমাদের নেই আর কিছু হারাবার
বিজয়ের দিন শুধু ষোলোই তারিখ।
বিজয়ের আনন্দে সত্যিই বাংলার আকাশ-বাতাস আনন্দিত, আনন্দিত বাংলার পাখি, গাছ, বা ঝোপঝাড়, সর্বোপরি আনন্দিত বাংলার মানুষ। কবির এ কবিতাটি না পড়লে এভাবে হয়তো ভাবা হতো না কোনোদিন।
একুশতম কবিতা ‘অনন্য রত্ন‘। কবিতাটি গাছ নিয়ে । গাছের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে । গাছ লাগানো যাদের কাছে ন্যাকামি বা শখের বিষয় মনে হয় এবং যারা গাছের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে বটে, কিন্তু গাছ লাগাতে চায় না, কবি তাদেরকে গাছের উপকারীতা বলে গাছ লাগাতে আগ্রহী করছেন৷ যেমন এক জায়গায় বলছেন—
থানকুনিতে ওষুধ খুঁজি
সে যে দারুণ পথ্য
সবুজ লতাপাতায় আছে অনেক নিগূঢ় তত্ত্ব
এভাবে আরও বলছেন—
আমলকি-নিম ঔষধিগাছ
হাত বাড়িয়ে ডাকে
অসীম ভেষজ লুকিয়ে আছে বনের ফাঁকে ফাঁকে।
সাম্প্রতিক সময়ে মানুষ অক্সিজেনের কদর বা প্রয়োজনীয়তা টের পাচ্ছে। অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা অসীম ৷ সে অক্সিজেন কোথায় পাওয়া যাবে, তা কবি পরিস্কারভাবে বলে বনবাদাড় বা গাছগাছালির যত্নআত্তি করতে হবে, সেটাও বলছেন এভাবে—
অক্সিজেনের গুদামবাড়ি
বনবাদাড়ে থাকে
মধু যেমন নিরাপদে থাকে মধুর কেক
তাই আমাদের বনবাদাড়ের
করতে হবে যত্ন
গাছগাছালি-বনবনানী অনন্য এক রত্ন।
পরের কবিতা ‘শরতের ফুল’৷ যিনি কবি, তিনি ফুলকে ভালোবাসবেন না, তা কি হয়! ফুলের প্রতি মুগ্ধ হয়ে তাইতো কবি বানিয়ে ফেললেন আস্ত একটা কবিতা!
শুরু থেকে কিছু পাঠ করি—
হিমঝুরি মিনজিরি
ফুলে ফুলে সাদা
বাড়ি বাড়ি ফোটে রোজ বারোমাসি গাঁদা
সবুজাভ ছাতিমের
সাদা সাদা ফুল
কবিদের করে দেয় মনটা ব্যাকুল।
ফুল সত্যিই কবির মন ব্যাকুল করে । ফুল কোমল, কবিদের হৃদয়ের মতো !
তেইশতম কবিতা ‘হতে চাই’। কবি কী কী হতে চান, পুরো কবিতা পড়ে সেগুলোকে যোগ দিলে সমাধান আসে কবি হতে চান প্রকৃতি। কবিতাটিতে আবারও প্রকৃতি উঠে এসেছে, এসেছে সবচেয়ে গভীরভাবে। স্পষ্ট করছি। এক স্তবক দেখুন—
আমি হতে চাই
শ্রাবণ-ভাদর
গুঁড়িগুঁড়ি বিষ্টির চিকচিক জল
বটের তলায়, শীতাতপ ছায়া সুবিমল।
প্রকৃতি মানেই সুন্দর৷ বৃষ্টি সুন্দর, সুন্দর রোদও। আপনি যখন সেই সৌন্দর্যকে অনুভব করতে পারবেন, তখন সেই সুন্দরকে ধারণ করতে চাইবেন আপনার শরিরে। কেননা মানুষ সুন্দরের পূজারি। কবির এই আকাঙ্খা থেকে কবির প্রকৃতি-প্রেমের গভীরতা সহজেই অনুমেয়।
আরও এক স্তবক পাঠ করা যাক—
আমি হতে চাই
ভোরের আবির
দুপুরের কাঠফাটা রোদ
ঝাঁজালো আগুন, বিদ্রোহী রাগ প্রতিশোধ ।
দুপুরের কাঠফাটা রোদ কবিকে রাগান্বিত করতে পারেনি। উল্টো জাগিয়েছে বোধোদয়। সচেতন ও সত্যিকার মানুষ যারা, তাঁঁরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রোদের মতো, অস্বস্তিদায়ক ।
চব্বিশতম কবিতা ‘আয়না’৷ আয়নায় দেখা যাচ্ছে কবি তোরাব আল হাবিবকে। যে বর্ণনা দিয়ে তিনি নিজেকে চেনাতে চেয়েছেন, স্বাভাবিকভাবে অন্য কবিদের সাথেও সে বর্ণনা সেঁটে দেওয়া যায়, যেহেতু বর্ণনা কবিতা-বিষয়ক।
যেমন শুরু দেখুন—
কবিতার কথামালা মনে তোলে ঢেউ
কবিদের মনটন বোঝে নাতো কেউ
মন করে উচাটন যেই ফোটে ফুল
পাখিদের মতো কবি দোদুল দোদুল ।
নিরেট সত্য । সকল কবি এখানে নিজেকে দেখাতে চাইবেন । যেভাবে দেখিয়েছেন কবি তোরাব আল হাবিব নিজেকে এভাবে—
জোছনার আলো দেখে কবি হয় বুঁদ
কবিতার কাঁচামাল মগজে মজুদ
তোতলামো এসে গেলে দমে যায় জিভ
ভালোবেসে লোকে ডাকে তোরাব হাবিব ।
এটি তোরাব আল হাবিবের নিজের জন্য অনন্য সৃষ্টি । কবির অবর্তমানে কবিতাটি পাঠ হবে । সবাই কবিকে আবার দেখতে পারবে কবির তৈরি করা আয়নায় । কবি বেঁচে থাকবেন হাজার বছর।
পরের কবিতা ‘সবুজ পাতায় রোদের ঝিলিক’। কবিতাটি কিশোরদের নিয়ে। সে কিশোর এখনকার কিশোর। ভিন্ন কিশোর। প্রকৃতি তার মোহে এসব কিশোরদের জড়াতে পারে না। কবি তা বলছেন এভাবে—
প্রকৃতির এই খেলার মাঝে
রঙধনু রঙ মেলার মাঝে
আজ কিশোরের মন ভরে না জোৎস্নারূপী চাঁদে
মন বসে না বাঁশবাগানে জোনাই-ঝিঝির ফাঁদে ৷
কেন পরিবর্তন এলো কিশোরদের মাঝে ৷ উত্তর দিয়েছেন এভাবে—
আজকালকার কিশোরগুলো
কাজের বেলা চায় না মূলো, চিন্তাচেতন ভিন্ন,
ইউটিউবে ব্যস্ত সময় কাটায়
জিমে’ল করে বার্তা দূরে পাঠায়
বাটন টিপেই কর্ম সারে দেয় এঁকে ফুল চিহ্ন
নেট দুনিয়ায় যুক্ত থাকে নয় মোটে বিচ্ছিন্ন ।
ছাব্বিশতম কবিতা ‘মায়াময় গ্রাম’ । কবি ভালোবাসেন দেশকে। আরও ভালোবাসেন গ্রামকে। তাই বারবার দেশ আর গ্রাম উঠে আসছে তার লেখায় বিভিন্ন রঙে। গ্রামকে যে ভালোবাসেন, সেই পরিস্কার বিষয় জানান দিচ্ছেন এই স্তবকে—
ধান হাসে মাঠে মাঠে সোনালি সে হাসি
সবুজের গ্রামখানি বড় ভালোবাসি
লাল, নীল, হলুদাভ রকমারি ফুল
সজীবতা এনে দেয় শান্তি আমূল ।
আলোচনার শুরু থেকে বারবার বলছিলাম যে, প্রকৃতিকে কবি তোরাব আল হাবিব অন্য কবিদের মতো দেখেননি ৷ যেভাবে দেখেছেন, সেভাবে সহজে দেখা যায় না । এই নতুনত্ব কীভাবে কবি জন্ম দিয়েছেন, তা স্বয়ং কবিই বলছেন এই কবিতার ৩য় স্তবকে—
গরু নিয়ে কাদামাটি পথে যায় চাষী
চিরায়ত সুন্দর রূপ অবিনাশী
দূর্বার গালিচাতে মায়াময় গ্রাম
হৃদয়ের চোখ দিয়ে দেখি অবিরাম ।
কপালের নিচে চোখ থাকে অধিকাংশের, থাকে না হৃদয়ে চোখ । হৃদয়ে যারা চোখ জন্ম দিতে পারেন, তারা হোন তোরাব আল হাবিব ।
পরেই আছে ‘করোনাকাল’ শিরোনামের একটি কবিতা৷ পৃথিবীতে পশু-পাখি আছে। আছে গাছপালা। আছে আরও কত কী! কিন্তু মানুষের বিচরণ ছাড়া পৃথিবী মৃতপ্রায়। বড় এই কবিতায় কবির উদ্দ্যেশ্য এটাই বুঝানো।
মানুষের এই দুর্যোগপূর্ণ মুহুর্তে পাখিদেরও মন খারাপ ছিল। কবি সেটা টের পেয়ে বলছেন—
ঝোপের আড়ে গোমড়ামুখো টুনটুনিদের ঝাঁক
তারাও হতবাক
নীরব-নিঝুম লাগছে বেজায় এই পৃথিবীর সব
বন্ধ কলরব
চাঁদের প্রাণ ছিল, প্রাণ ছিল রোদেরও। কিন্তু মানুষের দুর্যোগ দেখে প্রাণবন্ত ছিল না কেউই। কবি এটাও বুঝতে ভুল করেননি। বলছেন—
চাঁদের আলো রোদের হাসি মেঘের লুকোচুরি
তাও তো মৃতপুরী
ঝরণাধারা বৃষ্টি পতন মৌমাছিদের গান
সত্যি বেমানান
সারে সারে প্রকৃতির এই নজরকাড়া রূপ
জবানহারা বোবার মতো দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ ।
বইয়ের শেষ কবিতা ‘আবিররাঙা ভোর’ । চর্মচক্ষু বিদ্যমান আছে এমন ব্যক্তি সহজেই স্বীকার করবে ভোরের রূপ । সেই রূপবতী ভোরের চিত্র তুলে ধরেছেন কবিতায় । শুরু এরকম—
কিচিরমিচির পাখির ডকে
ঘুম ভেঙে যায় ঘুম
পরম স্নেহে মা জননী দেন কপোলে চুম
আবিররাঙা ভোরের আলো
যেই উঠোনে ছড়ায়
কুসুম কুসুম রোদ ছায়াতে ছোট্ট শিশু গড়ায় ।
সকালের সকল দৃশ্যই সুন্দর। কিন্তু সে সুন্দর ঘুমন্ত ব্যক্তি দেখে না । দেখেন কবি তোরাব আল হাবিব, তিনি ভোরে ঘুমান না। গ্রামের এ মোড় থেকে ও মোড় হাঁটেন, কখনও বসেন নদীর ধারে। গাছের নিচে। হাতে তাঁর খাতা-কলম। যা দেখেন, খসখস করে তা লেখেন পাতায় । পাঠক পড়ে । মুগ্ধ হয় । আওড়ায় একটিই কথা—
প্রকৃতিপ্রেমি তোরাব আল হাবিব, বেঁচে থাকুন প্রকৃতিতে, যতদিন প্রকৃতি বেঁচে থাকে পৃথিবীতে ৷
বই: আবিররাঙা ভোরের হাসি
লেখক : তোরাব আল হাবিব
ধরন: কিশোর কবিতা
উৎসর্গ : মাহমুদ বুলবুল
প্রকাশক : পাপড়ি
মূল্য : ২৩০ টাকা
মোট কবিতা : ২৮
পৃষ্ঠা : ৩২
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২১
প্রাপ্তিস্থান : পাপড়ি প্রকাশ
২০১, রঙমহল টাওয়ার, বন্দর বাজার, সিলেট
অনলাইন পরিবেশক : রকমারি ডটকম

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2016 Paprhi it & Media Corporation
Developed By Paprhihost.com
ThemesBazar-Jowfhowo