২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ রাত ১০:৩৮

তিড়িং বিড়িং ফড়িং ধরিং-এর সোজাসুজি পাঠ প্রতিক্রিয়া

ওয়াহিদ ওয়াসেক
  • আপডেট শনিবার, মে ২৯, ২০২১,
বই: তিড়িং বিড়িং ফড়িং ধরিং
লেখক: কামরুল আলম
প্রচ্ছদ: নিসা মাহজাবীন
প্রকাশক: পাপড়ি প্রকাশ
মূল্য: ১০০/-
তিড়িং বিড়িং ফড়িং ধরিং। শিশুতোষ ছড়ার বই। প্রচ্ছদ করেছেন নিসা মাহজাবীন। শিশুদের উপযোগী চাররঙিন প্রচ্ছদ। খুব স্মার্ট প্রচ্ছদ। বইটিতে আছে সহজ-সরল, ছোট ছোট তুলতুলে ১২টি ছড়া। একেবারেই পাতলা ১৬ পৃষ্ঠার রঙিন বই। পাতায় পাতায় আছে ছড়ার সাথে মিলিয়ে রঙিন ছবি। ছবিগুলো এঁকেছেন কবির আশরাফ। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক কবি আসলাম সানীকে। লিখেছেন কামরুল আলম।
কামরুল আলম। একাধারে ছড়াকার, গল্পকার, কথাসাহিত্যিক। এককথায় শিশুসাহিত্যিক। জন্মগ্রহণ করেছেন ২৫শে নভেম্বর, ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে। সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলায়। মোহাম্মদপুর গ্রামে। বাবা মরহুম কবি করামত আলী৷ মা হোসনে আরা বেগম। পেশায় প্রকাশক। পাপড়ি প্রকাশের সত্ত্বাধিকারি। লেখালেখি করেন ছোটদের জন্যেই।
বইটির প্রথম ছড়াই হচ্ছে ‘তিড়িং বিড়িং ফড়িং ধরিং’ শিরোনামের। অসাধারণ ছড়া। ছড়াটির নামকরণেই বইয়েরও নামকরণ করা হয়েছে। ছড়াকার শিশুদের উপযোগী শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন। ছড়াটির শেষ স্তবকটি এরকম—
তিড়িং বিড়িং ফড়িং ধরিং
রোদের আলোয় মিশে
লেজটা ছিঁড়ে পালায় ফড়িং
হারিয়ে ফেলি দিশে।
(তিড়িং বিড়িং ফড়িং ধরিং, পৃষ্ঠা: ০৫)
শিশুরা ফড়িং ধরিং খেলা খেলতে খুবই আনন্দ উপভোগ করে। সবুজ ঘাসে, ঝিঙেফুলে ফড়িংরা বসে। নাচানাচি করে। ওড়াউড়ি করে। শিশুরা চুপিচুপি ফড়িং ধরতে চায়। তাই না? আর যখন ফড়িংয়ের লেজটায় হাত দিবে তখনই ফড়িং উড়ে যায়। কখনও আবার ছিঁড়ে যায় লেজ। ইশ! কী চমৎকার দৃশ্য।
বইটির তৃতীয় ছড়াটি হচ্ছে ‘সখ’। খুব চমৎকার ছড়া। ছড়াটি যদিও শিশুতোষ কিন্তু সমাজসচেতন ছড়া। কী দারুণ অন্ত্যমিলও। ছড়াটির শেষ স্তবকটি পড়া যাক—
বক ধরেছে পুঁটির পোনা
সাপ ধরেছে বকটাকে
কাউকে মেরে পূরণ করা
যায় কি নিজের সখটাকে।
(সখ, পৃষ্ঠা: ০৭)
কী সুন্দর বার্তা। এখানে ছড়াকার খুব সতর্কতার সঙ্গে শিশুদের মতো করে একটা শিক্ষনীয় বার্তা দিয়েছেন। কাউকে মেরে কি নিজের সখ পূরণ করা যায়? যায় না। উল্টো হিতের বিপরীত হয়। ছড়াটি পড়ে শিশুরা যেমন আনন্দ পাবে তেমনি ভাবারও সুযোগ পাবে। বলা যায় ছড়াটি শিশুদের জন্যে শিক্ষনীয়ও বটে।
‘বিজয় মানে’ বইয়ের সপ্তম ছড়া। দারুণ একটি ছড়া। বাংলাদেশের বিজয় নিয়ে লেখা৷ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে। যুদ্ধ চলে দীর্ঘ নয় মাস। অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে। ছড়াটির একটি স্তবক এরকম—
বিজয় মানে লাখ শহিদের
রক্তে আঁকা ঘর
বিজয় মানে শেখ মুজিবের
বজ্রকঠিন স্বর।
(বিজয় মানে, পৃষ্ঠা: ১১)
বিজয় মানে কী? এখানে ছড়াকার বলেছেন, বিজয় মানে আনন্দ। মুক্ত আকাশ৷ মুক্ত পাখির গান। লক্ষ শহিদের রক্তে আঁকা ঘর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকঠিন স্বর। এককথায় বিজয় মানেই বাংলাদেশ।
বইটির অষ্টম ছড়া ‘আলোর ধারা’ শিরোনামের। ইসলামি ছড়া। ছড়াটি অনন্য। একটি স্তবক পড়া যাক—
মরুর বুকে এলেন নবী
চাঁদের মতো ঠিকই
আরবসহ বিশ্বভুবন
করলো ঝিকিমিকি।
(আলোর ধারা, পৃষ্ঠা: ১২)
পৃথিবী যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত। হিংসা-বিদ্বেষের ছড়াছড়ি। হানাহানি-মারামারি চারিদিকে। ঠিক তখনি প্রিয় নবী মোহাম্মদ মোস্তফা (সা:) জন্মগ্রহণ করেন। চাঁদের মতোই। চাঁদ যেমন চারিদিকে জোৎস্না ছড়ায়। আলোয় ঝিকিমিকি করে। তেমনি প্রিয় নবীর আগমনে আরবসহ পুরো বিশ্ব আলোকিত হয়। আলোয় ঝলমল করে ওঠে। এখানে ছড়াকার কী চমৎকার উপমা ব্যবহার করেছেন। শিশুরা সহজেই বুঝতে পারবে। তাই না?
বইয়ের আরেকটি ছড়া ‘ফুলের সাথে খেলা’ শিরোনামের। এটি বইয়ের নবম ছড়া৷ এককথায় ছড়াটি অনবদ্য। ছড়াটির একটি স্তবক এরকম—
সূর্যমুখী গন্ধরাজ আর
গোলাপফুলের সাথে
বিকেলবেলা খেলতে যাবো
বলটা নিয়ে সাথে।
(ফুলের সাথে খেলা, পৃষ্ঠা: ১৩)
শিশুরা সাধারণত খেলাধুলা করে বন্ধুদের সাথে। কিন্তু ফুলের সাথে কি খেলা যায়? যায়। কীভাবে? কল্পনায়। আর এখানেই ছড়াকারের সফলতা। শিশুদেরকে কল্পনার রাজ্যে নিয়ে যাওয়া। যা শিশুদের পছন্দের বিষয়৷
বইটির দশম ছড়াটি হচ্ছে ‘এক যে ছিল ভূত’। কী দারুণ ছড়া। একটু দীর্ঘ। কিন্তু অসাধারণ। দিনের বেলা ভূত পালিয়ে যায়। দেখা যায় না৷ কিন্তু রাতের বেলা? ছড়াকার কী বলেছেন? ছড়াটির শেষ স্তবকটি পড়া যাক—
দিনের আলোয় ভূতটা যেত
পালিয়ে অনেক দূর
সন্ধ্যা হলেই ফের বাজাতো
ভয়ঙ্কর এক সুর।
(এক যে ছিল ভূত, পৃষ্ঠা: ১৪)
ভূত। শিশুদের ভয়ের বিষয়। আবার পছন্দের বিষয়ও। শিশুরা ভূতবিষয়ক ছড়া, গল্প পড়তেই পছন্দ করে। আসলে কি ভূত বলতে আদৌ কিচ্ছু আছে? মনে হয় না আছে।
বইয়ের সর্বশেষ ছড়া ‘বাংলাদেশের সবুজ বুকে’ শিরোনামের। কী অসাধারণ ছড়া৷ ছড়াটির একটি স্তবক এরকম—
সবুজঘেরা এই দেশেতে
ফুল-পাখিদের বাস
দেশকে নিয়ে বুকের মাঝে
স্বপ্ন করি চাষ।
(বাংলাদেশের সবুজ বুকে, পৃষ্ঠা: ১৬)
সবুজ-শ্যামল এই প্রকৃতিতে মানুষ বাস করে। বাস করে পশু, পাখি, গাছপালাও। এককথায় আমাদের আশেপাশের সবকিছুই। আর সবাই দেশকে ভালোবাসে। বুকের মাঝেই তুলতুলে রঙিন স্বপ্ন চাষ করে। এখানে ছড়াকার শিশুদেরকেও দেশকে ভালবাসতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
তিড়িং বিড়িং ফড়িং ধরিং। চকচকে-ঝকঝকে বই। ছোট ছোট শিশুতোষ ছড়ার বই। এককথায় ‘তিড়িং বিড়িং ফড়িং ধরিং’ শিশুদের মতোই। কিন্তু বইয়ে তেমন কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি চোখে পড়েনি। বানানেও সমস্যা নেই তেমন। তবে দু-একটা বানানে সমস্যা আছে। ‘কিষাণ’ শিরোনামের ছড়ায় ‘হাটে’ এটা হাঁটে হবে। একজায়গায় হাঁটে লেখাও আছে। কিন্তু ওখানে সম্ভবত চন্দ্রবিন্দু মিস্টেক হয়েছে। আবার ছড়ার শিরোনামে ‘কিষান’ লেখা। ছড়ায় ‘কিষাণ’ লেখা। কিন্ত শব্দটি ‘কিষান’ হবে। আরেকটি শব্দ ‘জীবন-যাপন’। আসলে শব্দটি ‘জীবনযাপন’ হওয়ার কথা।
আরও কিছু বানান আছে যেমন: ‘কাঁপতো, উঠতো, ঘুরতো, বলতো, হতো, করতো, বাজাতো’ এজাতীয় বানানগুলোতে ‘ও’ কার এখন আর ব্যবহার করা হয় না৷ কিন্তু আমার মনে হয় শিশুরা ‘ও’ কারসহ পড়তেই পছন্দ করে। এমনকি উচ্চারণেও বিভ্রান্ত হবে না শিশুরা। আর বইয়ের ভিতরের ছবিগুলো একরঙিন না হয়ে চাররঙিন হলে বেশ ভালো হত।
আরেকটি বিষয়ে আলোচনা না করলেই নয়। বইয়ের নামকরণের ‘ধরিং’ শব্দটি নিয়ে। যদিও আমি সাহিত্যসমালোচক কিংবা গবেষক নই। তবুও দু-এক কথা বলি।
‘ধরিং’ শব্দটি ছড়াকার কামরুল আলমের অনেক ভক্ত মনে করেন তাঁর নিজস্ব বানানো শব্দ। এমনকি ছড়াকার নিজেও মনে করেন। এমনকি নজমুল হক চৌধুরী একটি প্রবন্ধেও বলেছেন, “বিশেষ করে ‘তিড়িং বিড়িং ফড়িং ধরিং’ নামের শেষ শব্দটি অর্থাৎ ‘ধরিং’ শব্দটি কামরুল আলমের নিজস্ব বানানো শব্দ।” শব্দটি ছড়াকার ২০১৭ বা ২০১৮ সালেই প্রথম ব্যবহার করেছেন।
আসলে ‘ধরিং’ শব্দটি একটি ননসেন্স ওয়ার্ড। অর্থাৎ অর্থহীন শব্দ। যা কোনো অভিধানে নেই। তবে ধরে নিতে পারি ‘ধরি’ শব্দের প্রতিশব্দ। কেননা অনেকেই ‘ধরি’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবেই ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ‘ধরিং’ শব্দটি কি ছড়াকার কামরুল আলমের নিজস্ব বানানো? আমার মতে না। কামরুল আলম শব্দটি ব্যবহার করেছেন ২০১৭ বা ২০১৮ সালেই। কিন্তু এর অনেক অনেক আগেই অনেকেই ‘ধরিং’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। রফিকুল হক দাদুভাই থেকে নিয়ে প্রায় জনপ্রিয়, বিখ্যাত অনেকেই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যা ২০১৭ বা ২০১৮ সালের পূর্বেই। যা ছড়াকার কামরুল আলমের অজানাই হতে পারে। আবার হয় তো কামরুল আলম যখন ‘ধরিং’ শব্দটি ব্যবহার করেন তখন উনার মাথায় এই শব্দটি প্রথমই আসে। তাতে কি ‘ধরিং’ শব্দটি উনার নিজস্ব বানানো শব্দ বলা যায়? এরকম আরও অনেক শব্দ আছে। যা ব্যবহার করা হয়েছে বা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘করিং, গড়িং, চড়িং, নড়িং, পড়িং, ভরিং, মরিং, লড়িং, সরিং’ প্রভৃতি।
যাইহোক ‘তিড়িং বিড়িং ফড়িং ধরিং’ শিশুদের পাঠ্যবইয়ের মতো পাঠযোগ্য একটি বই। বইটি শিশুদের হাতে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব অভিভাবকদেরই। আমি বইটির ও লেখকের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।
২৮ মে, ২০২১
জকিগঞ্জ, সিলেট।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2016 Paprhi it & Media Corporation
Developed By Paprhihost.com
ThemesBazar-Jowfhowo