ইয়ের নাম ‘আবিররাঙা ভোরের হাসি’ । কবি ভোরের সান্নিধ্যে গিয়েছেন। তখন ভোরকে হাসতে দেখেছেন৷ ভোরকে তিনি রাঙানো পেয়েছেন। আবিরের (এক প্রকার তরল পদার্থ, অন্য নাম ফাগ) রঙে রাঙানো। সেটি দিয়েছেন বইয়ের শিরোনাম। যা প্রকৃতির প্রতি তার মমতা বা প্রকৃতির কতটা কাছাকাছি তিনি গিয়েছেন, তার প্রতিনিধিত্ব করছে৷ বইটি খুললে এর আরও প্রমাণ মিলে। কেননা, সবচেয়ে বেশি যে বিষয় ওঠে এসেছে তার বইয়ে, তা প্রকৃতি। নানান ঢঙে তিনি প্রকৃতিকে দেখেছেন, দেখিয়েছেন।
বইটির ফ্ল্যাপ লিখেছেন শিশুসাহিত্যিক হাসনাত আমজাদ । শেষদিকে তিনি লিখেছেন, ‘আবিররাঙা ভোরের হাসি তোরাব আল হাবিবের সেই গ্রন্থ যার প্রতিটি পাতায় রয়েছে মন ভালো করা কিশোর কবিতা, মন ছুঁয়ে যাওয়া এমন কিছু ছোটদের কবিতা যা শুধু কিশোরদের নয়, বড়দের মনেও দোলা লাগাবে’।
হাসনাত আমজাদ এর এ কথার সত্যতা নির্ণয় করতে খুব বেশি দূর যেতে হয়নি৷ বরং প্রথম কবিতায় আছে তার প্রমাণ। দেখা যাক প্রথম কবিতাটি—
শিরোনাম ‘স্বদেশ আমার সোনার মোহর’। নামে বিস্ময়! স্বদেশ কীভাবে সোনার মোহর হলো? দেশে এমন কীসের উপস্থিতি তিনি উপলব্ধি করলেন যে, উপমা দিলেন সোনার মোহর এর সাথে। আচ্ছা তাহলে এগুনো যাক।
কবিতাটিতে কবি দেশকে তুলে ধরেছেন বললেও মূলত গ্রাম বেশি ফুটে ওঠেছে। কেননা কবিতায় যা যা এনেছেন, তা গ্রামেই উপস্থিত।
শুরু করেছেন এভাবে—
ফুল পাখি লতাপাতা ভরা এই দেশ
চারদিকে মায়াময়
বিছানো আবেশ
অর্থাৎ সাধারণভাবে প্রথমেই দেশের একটি পরিচয় দিয়েছেন খুবই মায়াভরা কথায়৷ যা পাঠককে দীর্ঘ কবিতার শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাবে। এরপর নদী, পাহাড়, ঘাস সবার কাছে গিয়েছেন৷ কে কী করছে, তা বলছেন। যেমন বলছেন—
নদীগুলো ঢেউ তুলে নিরবধি বয়
ভাটিয়ালি তাল-সুর কী যে মধুময়
ঝিরিঝিরি বাতাসের
কানে বাজে গান
পুকুরের জলে ওঠে ঢেউ কলতান।
বেতসের ঝোপে থাকে আর নল আর খাগ
রাঙা ঠোঁটে হেসে ওঠে
কলমি-পরাগ
কদমের ডালে বাঁধে ঘুঘুপাখি নীড়
সকালের সুয্যিটা ছড়ায় আবির
ফুলে ফুলে চুমো দেয়
কত মধুকর
আমাদের দেশ যেন সোনার মোহর।
এতটুক পড়ার পর হাসনাত আমজাদের সেই কথার সত্যতা পাই। কী এক মায়ায় যেন জড়িয়ে যাই! কবিতাটি তাই আবার পড়ি। আবার পড়ি। বারবার পড়ি। পরিস্কার হয় এটাও যে, কেন সোনার মোহর এর সাথে উপমা দিয়েছেন দেশকে৷
কবিতাটিতে আরও একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, সচরাচর প্রকৃতি নিয়ে এমন লেখা দেখা যায় না৷ যা লেখা হয়, সেসবে তেমন নতুনত্ব থাকে না। এই কবিতাটি পড়ে একজন শহরে বেড়া ওঠা কিশোরের মনে প্রশ্ন ঝমবে, বেতস কী? নল আর খাগই বা কী?
সুতরাং কবি যে এই কবিতার মধ্য দিয়ে গ্রাম-বিচ্ছিন্ন মানুষদের গ্রামের সাথে একটা বন্ধন তৈরি করবেন, সে বিষয়ে সন্ধেহ নেই।
যেতে যেতে কবিতার শেষ অংশ পড়ুন—
থানকুনি-পুঁইশাকে ভরা চারিদিক
নদীতীরে বালুকণা
করে চিকচিক
লটকন আমলকি সুপারি ও পান
হলুদাভ হয়ে ওঠে কাঁঠাল বাগান
দুটি চোখ ভরে যায়
দেখে পরিবেশ
পৃথিবীর সেরা সে যে আমাদের দেশ।
‘সবুজ গাঁয়ের পরশ’ বইয়ের দ্বিতীয় কবিতার শিরোনাম। শুরুতেই কয়েকটি সরল শব্দে গ্রামের সর্বোচ্চ সৌন্দর্য তুলে ধরা হয়েছে৷ কবি বলছেন—
ছবির মতো গ্রামটা আমার
গ্রামের মতো ছবি
কোনোকিছুকে কখন ছবির সাথে তুলনা দেওয়া হয়? যখন তা অকল্পনীয় সুন্দর হয়৷ কারণ শিল্পী একটি ছবি যেভাবে ইচ্ছে এঁকে সৌন্দর্য বাড়াতে পারেন। সুতরাং কবি গ্রামকে ছবির সাথে তুলনা দিয়ে বুঝালেন যে, তাঁর গ্রাম অবর্ণণীয় সুন্দর।
এরপর ছবির সাথে কেন তুলনা করেছেন, তা বলেছেন পুরো কবিতাজুড়ে। কবি বলতে শুরু করেছেন—
ছবির মতো গ্রামটা আমার
গ্রামের মতো ছবি
বাঁশঝাড়ের অই ফাঁকফোকরে ওঠে প্রভাত-রবি।
দোয়েল ডাকে সদলবলে টুনটুনি গায় গান
মুর্তাবেতের শীতলপাটি
মায়ের অবদান।
গ্রাম নিয়ে যত লেখালেখি হয়, সেসবে সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ হয়তো সেই লেখক শুধু গাছ আর পাখি নিয়ে লিখেন, বা পুকুর আর মক্তব নিয়ে লিখেন৷ কিন্তু কবি তোরাব আল হাবিব হাঁটলেন নতুন পথে। টের পেলেন গ্রাম নিয়ে আরও অনেককিছু লেখার আছে। তাই তুলে আনলেন গ্রামের সেসব সৌন্দর্য, যেগুলো নিয়ে অন্য লেখকগন লেখার প্রয়োজন মনে করেননি বা সেগুলো এড়িয়ে গেছেন। কবি বলছেন—
কদম ডালে ঘুঘুর বাসা
জারুল গাছে ফিঙে
উঠোনজুড়ে শিমের মাচা নয়ন জুড়ায় ঝিঙে।
বাড়ির পাশে সর্ষে ক্ষেতে হলুদ ফুলের হাসি
তাল-গুবাকের আকাশ ছোঁয়া
দৃশ্য অবিনাশী।
বিল-বাঁওড়ে বেষ্টিত গাঁ
লতায়-পাতায় ঘেরা
আলোর পিদিম দেয় জ্বালিয়ে রাতের জোনাকেরা।
দূর্বাঘাসের সবুজ চাদর চতুর্দিকেই পোঁতা
পাখপাখালি গাছগাছালির
নিবিড় সমঝোতা।
কবি গাঁয়ের প্রকৃতি নিয়ে ভাবার সাথে সাথে ভাবেন গাঁয়ের সরল-সহজ মানুষদের নিয়ে৷ তাই তাঁর লেখায় সহজে ওঠে আসে—
রাখাল ছেলে গরু নিয়ে
যায় সে দূরের মাঠে
সাঁঝের বেলা বাড়ি ফেরে সূর্য গেলে পাটে।
নদীর বুকে পালতোলা নাও, দাঁড় বেয়ে যায় মাঝি
কৃষক তোলে বৈশাখি ধান
রেখে জীবনবাজি।
গ্রাম মানুষকে কবি বানাতে পারে। গ্রাম পারে মানুষকে শুদ্ধ সুন্দর করতে। কবিতার শেষে কবি সেটাই বলছেন—
ঢোলকলম আর কলমিলতা
কেয়া চাপার গন্ধে
বিরস এ মন চনমনে হয় মাতে ছড়ার ছন্দে।
ভোরের বাতাস স্নিগ্ধ সতেজ মন করে দেয় সরস
যে পেয়েছে এমনতর
সবুজ গাঁয়ের পরশ ।
পরের কবিতার শিরোনাম ‘ফুল’ । ফুল যখন কারও লেখার বিষয় হয়, তখন তাতে প্রেম থাকে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কবি এক্ষেত্রে দৃষ্টিকে বিস্তৃত করেছেন। ফুল যে কারও দুঃখেরও কারণ হয়, তা বলছেন শুরুর দিকে—
ফুল মানুষকে আনন্দ দেয়
ফুল মানুষকে হাসায়
ফুল কখনও শোকের জলে—দুখের নদে ভাসায়
ফুল মানুষকে স্বপ্ন দেখায়
ফুল করে দেয় নিঃস্ব
বলতে গেলে ফুলের প্রেমে নতজানু বিশ্ব ।
এতটুক পড়ার পর আপনি ভাববেন, ফুল আবার মানুষকে শোক জলে ভাসায় কীভাবে? ফুল স্বপ্ন দেখানোর মতো বড় কাজ কীভাবে করতে পারে? কীভাবেই বা ফুল মানুষকে নিঃস্ব করে?
এরকম ভাবনায় কবি পাঠককে রেখেছেন কবিতার শেষ পর্যন্ত। কবিতাটি পড়লে পাঠক যেভাবে ভাবনার সাগরে ডুববেন, সেভাবে ভালোলাগার হাওয়ায় দোল খাবেন। কবিতার আরও এক স্তবক শুনানোর লোভ সামলাতে পারছি না—
ফুল মানুষকে কথা শেখায়
ফুলের আছে দন্ত
ফুলের ভেতর জমা থাকে মধু অফুরন্ত
ফুলের আছে চক্ষু ও ঠোঁট
ফুলের আছে কর্ণ
ফুলের আছে বুকের ভেতর সকল ভাষার বর্ণ।
কবিতাটি পড়ে পাঠক ফুল নিয়ে ভাববে। ফুলের প্রতি তৈরি হবে এতোই আগ্রহ, তখন তোরাব আল হাবিবের পাঠকসমাজ হয়ে যেতে পারে ফুল-গবেষক !
ফুল এর পরের কবিতা ‘উড়াল’ ৷ কবি উড়াল দিয়েছেন স্বপ্নে। মানুষ স্বপ্নে কত কী করে। কবি স্বপ্নে উড়েছেন। উড়ার গল্প শুনিয়েছেন পুরো কবিতায়। শুরু এরকম—
ঘুম ছাড়ে না ঘুম ছাড়ে না
চক্ষু ঢুলুঢুলু
ঘুমের ঘোরে যাচ্ছি উড়ে হাওয়াই হনুলুলু।
পঙ্খিরাজে যাচ্ছি চড়ে
থামছি না তো বৃষ্টি ঝড়ে
যাচ্ছি উড়ে ঢাকা থেকে ওই সুদূরের পেরু
স্বপ্নযোগে দেখছি একা বিচিত্র সব মেরু।
সুন্দর শব্দচয়নের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে দেখিয়েছেন অন্ত্যমিলের খেল।
মুগ্ধ না হয়ে পারি না, যখন বলেন—
ফল-ফলাদির বন পেরিয়ে
তাড়াহুড়োর ক্ষণ পেরিয়ে
যাচ্ছি উড়ে ফুলের দেশে
দুধেলসাদা চুলের দেশে
উড়ছি আমি ঘুড়ির মতো
চরকাকাটা বুড়ির মতো
সাধারণ স্বপ্নকে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করার এ চেষ্টা অনুভব করে পাঠকমাত্রই মুগ্ধ হবে।
পঞ্চম কবিতা ‘ষোলোই ডিসেম্বর’ ৷ আমরা যখন দেখলাম একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বরে আনন্দের হাসি ফুটেছে বাঙলাদেশের মুখে ৷ যখন দেখলাম হাসি ফুটেছে সকল বাঙালির মন ও মুখে, কবি তখন দেখলেন অন্যকিছু। দেখলেন বিজয়ের আনন্দে হাসছে পাখি, হাসছে গাছের পাতা, নদী, ফুলও । কবি তখন হেসে হেসে লিখে ফেললেন একটি দীর্ঘ কবিতা। যার শুরু এরকম—
উঠলো হেসে ডালের পাখি উঠলো হেসে পাতা
উঠলো হেসে বাগানভরা ফুল
উঠলো হেসে নদীর দু’টি কূল
উঠলো হেসে খুকুর তুলি, উঠলো হেসে খাতা
উঠলো হেসে দূর আকাশের চাঁদ
মায়ের কোলে উঠলো হেসে বাঁধভাঙা আহ্লাদ ।
চমৎকার কবিতাটি শেষ করার পর পাঠক পড়বে ‘শীতের বাহক’ কবিতাটি৷ যা বইয়ের ষষ্ঠ কবিতা। কবিতায় শরৎ-ঋতুর কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কবি মোহনীয় এই ঋতুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন কবিতায়। শুরুতে বলছেন—
একসকালে শরৎ এসে
ঠোঁট বাঁকিয়ে ডাকলো
নদীর ধারে দোলখেলানো কাশের ছবি আঁকলো
বানে আসা বালুর ঢিবি
সবুজে ঘাস ঢাকলো।
শরৎকালে কখনও কখনও বৃষ্টি হয়। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি৷ আবার স্বচ্ছ হয়ে যায় আকাশ৷
বৃষ্টি-রোদের এ লুকোচুরি মুগ্ধ করে যে কোনো কবিকে। এই কবিও মুগ্ধ হয়েছেন। তাইতো লিখে ফেললেন—
আকাশজুড়ে মেঘের মিছিল
এদিক ওদিক ছুটলো
ডালে ডালে পাতায় পাতায় জুঁই-কামিনী ফুটলো
বর্ষা ভুলে মেঘ ছাপিয়ে
সূর্য হেসে উঠলো।
শরৎ যখন হাসে, যখন আকাশে
মেঘ উঁকিঝুঁকি দেয়, শরতের হাওয়ায় যখন দোল খায় দিগন্ত-বিস্তৃত রোপা আমন ধানের সবুজ ক্ষেত, তখন কবির অন্তরে প্রকৃতিপ্রেম যেন আরও বাড়ে৷ তিনি লিখেন—
একসকালে শরৎ এসে
খিলখিলিয়ে হাসলো
পেঁজামেঘের জমাট দলা শূন্য হাওয়ায় ভাসলো
আমন ধানের সবুজ রোপন
মাঠে চাষি চাষলো।
শরৎপ্রেমি কবির এই কবিতাটির প্রেমে পড়তে পারে খোদ শরৎও !
সপ্তম কবিতা ‘সেই স্মৃতি সেই ক্ষণ’ ৷ মানুষ বড় হয়, কিন্তু শৈশব ভুলে না ৷ সাধারণ হলে শৈশবের স্মৃতি বলে মুখে, আর কবি হলে লেখায়। তাইতো কবি ফেলে আসা শৈশবকে স্মরণ করতে রচনা করলেন কবিতা, বেশ দীর্ঘ । শুরুর দিক থেকে কিছুটা পড়া যেতে পারে—
আমগাছ জামগাছ বেতসের ঝোপ
ডালে ডালে পাখিদের নিরাপদ খোপ।
ঘুঘু আর শালিকের সাথে ছিল প্রেম
সবুজাভ শৈশব চির মোলায়েম।
জীবনটা ছিল এক
ফড়িঙের ডানা
হেসেখেলে বেড়িয়েছি
ছিল নাতো মানা।
কবিতাটিতে কবি বিচরণ করেছেন শৈশবে। বা কবিতাটি বিচরণ করেছে কবির শৈশবে! শৈশব-স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে শেষ করেছেন কবিতা। যেতে যেতে জানিয়েছেন, তিনি শৈশবকে ভালোবাসেন। ভালোবাসেন শৈশবের প্রতিটা মুহুর্তকে ।
রাখালের মোহনীয় বাঁশিটার সুর
দুপুরের ঝলমলে আলো রোদ্দুর।
মাঝনদী বরাবর পালতোলা নাও
পেছনে সে ফেলে আসা ছোটপাড়া গাঁও।
চাষিদের ছাতা মাথা
কিষানের হাসি
সেই স্মৃতি সেই ক্ষণ
আজো ভালোবাসি।
পরের কবিতা ‘আজব ছুটি’ । করোনায় সবাই যখন ছুটি পেয়েছিলো, তখন থাকতে হয়েছিলো ঘরে৷ অন্য যেকোনো ছুটির চেয়ে এ ছুটি ছিলো আলাদা। কোথাও বেড়াতে যাওয়া মানা, এমনকি ঘরের বাইরে যাওয়াও ৷ কিশোর-মনের কষ্ট বুঝেছিলেন কবি । সেটাই বললেন কবিতায়। শুরুর দিকটাই পড়ুন না !—
এই ছুটিতে আনন্দ নেই এই ছুটিতে কষ্ট
এই ছুটিতে মনগহনে বিষাদ বাড়ায় পষ্ট
এই ছুটি তো সঙ্গত্যাগি এই ছুটি তো শাপ
এই ছুটিতে দিবসযামী বাড়ায় মনস্তাপ
এই ছুটিতে স্বপ্ন ভাঙে মন ভেঙে হয় চুর
এই ছুটিতে দল বেঁধে তো কেউ করে না ট্যুর।
শুধু কি কিশোররা এ যাতনা টের পেয়েছিলো? না, বরং বাঙলাদেশের সবাই ছিলো বিপদে! কবি সেটাও বুঝেছেন ৷ তাই তো কবিতার শেষে সেটা বলেছেন এবং চেয়েছেন করোনার হাত থেকে মুক্তি । —
অদ্ভুত এক ছুটি নিয়ে আমরা আছি বন্দি
এমন ছুটির যায় না পাওয়া আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী
ছুটি নিয়ে এই বাঙালি পড়ছে ভীষণ ফান্দে
একলা একা ঘরের ভেতর ছুটির জ্বালায় কান্দে।ওহে ছুটি দাও না বিদায় বাড়াসনে দিন আর
মন থেকে চাই ধ্বংস কেবল নোভেল করোনার।
পরের কবিতার শিরোনাম ‘প্রতিস্থাপন’ ৷ গম্ভীর শিরোনাম। বাহ্যিক দৃষ্টিতে কবিতার সাথে শিরোনামের মিল না পাওয়া গেলেও কবিতাটি পড়ে আমি একটি মিল দাঁড় করিয়েছি ৷ সুক্ষ্ম-মিল। কবিতায় কবি কী কী হারিয়ে গেছে, তার একটা বর্ণনা দিয়েছেন৷ কবিতার শেষ লাইনে হতাশ-কন্ঠে বলছেন—
জায়গা করে নিচ্ছে কেবল
হাজার অসঙ্গতি
বুঝা যাচ্ছে যে, কবি যথেষ্ট হতাশ এ কারণে যে, কেন সেগুলো হারালো, আর কেন সেগুলোর জায়গা জুড়লো অসঙ্গতি ৷ তাই কবি যা যা হারিয়েছে, সেগুলো যে আবার ফিরে পেতে চান, শিরোনাম ‘প্রতিস্থাপন’ দিয়ে এককথায় হয়তো সেটাই বুঝাতে চেয়েছেন । কবিতার শেষদিক এরকম—
হারিয়ে গেছে বৌচি খেলা
দখিনমাঠে ষাঁড়ের মেলা
হারিয়ে গেছে গোল্লাছুটের গোল্লা
হারিয়ে গেছে আদব-লেহাজ
আর খাঁটি সব মোল্লা ।
হারিয়ে গেছে বনের ঝিঁঝি
নীলাভ প্রজাপতি
জায়গা করে নিচ্ছে কেবল
হাজার অসঙ্গতি।
‘ডাক’ দশম কবিতা । কবিতায় কবি তাদেরকে জাগাচ্ছেন, যারা ভোর কাটায় ঘুমে৷
শুরুতে বলছেন—
হাত বাড়িয়ে ভোরের বাতাস ডাকে
বোকানদীর বাঁকে
ঘুমের ঘোরে আর থেকো না
আর রেখো না বন্ধ সকল দোর
ডাকছে তোমায় কোমল বায়ের কুঞ্জ-কূজন ভোর।
এখানেই শেষ নয়। কী দরদী ভাষায় ভোরের উপকারিতা বলছেন, যেন সবাই ঘুম থেকে জাগতে উৎসাহ পায়। কবি বলছেন—
ভোরের ছবি রোদ ছড়িয়ে ডাকে
চিরলপাতার ফাঁকে
ভোরের রোদে দাওয়াই আছে
বালিশ ছেড়ে ওঠো
দূর্বাঘাসের মেঠোপথে জোরকদমে ছোটো
ভোরবেলাতে যায় পাওয়া যায়
নির্ভেজাল এক বায়ু
সেই বায়ুতে হাঁটলে পরে বাড়ে নিরোগ আয়ু
স্নিগ্ধ বাতাস স্নিগ্ধ আলো স্নিগ্ধ শিশিরকণা
প্রত্যুষে দেয় ধুয়ে মুছে মনের আবর্জনা ।
ভোরে অনেকেই ঘুমে থাকে, তাই বলে সব কাজ তো থেমে থাকে না ৷ তখনও পৃথিবী চলে তার গতিতে। কাজের মানুষ লেগে যায় কাজে। বরং ভোর অন্য সময়ের চেয়ে বেশি সুন্দর। কবিতার শেষদিকে এগুলোই বলা হচ্ছে—
ডাকছে নদী ছলাৎ-ছলাৎ সুরে
যেতে সমুদ্দুরে
নৌকা চলে ভাটির দেশে
গায় মাঝিরা গান
জলের ধারা কানে বাজায় মধুর কলতান
ভোরের মাঝি ভোরের কিষাণ ডাকে
দেখতে আকাশটাকে
নীলাভ আকাশ ফটিক নদী
নির্মলতায় ভরা
ভোরবেলাতে জাগলে তবে জাগবে বসুন্ধরা।