২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ সকাল ৮:১৬

তরুণ ছড়াকার খালিদ বিন শাহিদের প্রথম ছড়াগ্রন্থ ছড়া স্বপ্ন হাসে চোখে : চিন্তায় স্বপ্ন বুনন

মুহাম্মদ আব্দুল বাছিত
  • আপডেট সোমবার, জুন ৭, ২০২১,

ছড়াকার খালিদ বিন শাহিদের ‘স্বপ্ন হাসে চোখে’ গ্রন্থটি হাতে নিতেই মনে পড়লো দু’জন বিখ্যাত ব্যক্তির কথা। তাদের একজন লেখিকা, অন্যজন দার্শনিক। মূলত দু’জনই সময়ের মনীষা ছিলেন। তারা তাদের সৌকর্য চিন্তা দিয়ে একটি স্বপ্নের পৃথিবী নির্মাণ করার কথা বলেছেন। তাদের ভাষায় সেই স্বপ্নকে উপস্থাপন করেছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।
তাদের মধ্যকার প্রথমজন আমেরিকান লেখিকা এ্যাশলি স্মিথ বলেছেন, ‘জীবন সৌন্দর্যে পূর্ণ। মৌমাছির দিকে তাকাও, শিশুদের হাসি মুখের দিকে তাকাও। বৃষ্টির ঘ্রাণ নাও, বাতাসের স্পর্শ নাও। জীবনকে পূর্ণ ভাবে উপভোগ করো, আর নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রয়োজনে লড়াই করো’।
দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব দার্শনিক রালফ ওয়ালডো এমারসন বলেছেন, ‘পথ যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকেই যেও না যেদিকে কোনও পথ নেই, সেদিকে হাঁটো এবং নিজের চিহ্ন রেখে যাও’। ছড়াকার খালিদ বিন শাহিদের ছড়াগ্রন্থটিই সেই চিহ্ন। মূলত প্রতিটি সৃষ্টিই লেখকের জন্য জগতের বুকে এক একটি চিহ্ন। বৈষয়িক দৃষ্টিতে বিত্ত বৈভবকে মর্যাদা কিংবা অস্তিত্বের মাপকাঠি মনে করলেও, এই দৃষ্টিভঙ্গি যে একেবারে ভুল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সার্বজনীন জীবনদর্শন-ই বলে দেয় ব্যক্তির মহৎ কর্মই পৃথিবীর বুকে তার অস্তিত্ব। একটি বই তারই দ্যোতক।
দুই.
তখন সবেমাত্র বিয়ে করেছি। শ্বশুরবাড়িতে দাওয়াতে গিয়েছিলাম। মাগরিবের নামাজ পড়ে বেরিয়েছি, এমন সময় আমার একজন মাওলানা বন্ধু বললেন-খালিদের কথা! লেখালেখি করে! সে পাশেই ছিল। ঢাকায় মাদরাসায় পড়ে, নিশ্চয়ই বড় আলেম হবে ভবিষ্যতে, ওর বিনয় ও নম্রতা সে ভবিষ্যতকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তার সাথে নিজেই কথা বললাম। আমাকে কয়েকটি ছড়া দেখালো। পড়লাম। অভিভূত হলাম। প্রায় দুই বছর আগের কথা! ভাবলাম, এই এলাকায়ও এত ভালো ছড়াকার আছে! পরে সব খবর নিয়ে জানতে পারলাম, তিনি আমার ছোট্ট মামা শ্বশুর। গত বইমেলায়ই তার প্রথম ছড়াগ্রন্থ ‘স্বপ্ন হাসে চোখে’ দেশের সুপরিচিত প্রকাশনা সংস্থা ‘দাঁড়িকমা’ থেকে প্রকাশিত হয়। অপেক্ষায় ছিলাম গ্রন্থটি কবে হাতে আসবে। নানামাত্রিক ব্যস্ততায় সেটা আর হয়ে উঠছিল না। গত ঈদেই গ্রন্থটি সে আমার হাতে দিল। পড়লাম। সেই আগের মতো অভিভুবন আমার মধ্যে আবিষ্কৃত হলো। সত্যিই সে এক প্রতিভাধর ছড়াকার। ছড়াই তার প্রমাণ। সাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ সেবক (!) হিসেবে তার ছড়াগ্রন্থ সম্পর্কে না লিখলে নিজের কাছেই খারাপ লাগবে। অবশ্যই এটা তার প্রাপ্য। আমার প্রতি তার হক্ব।
তিন.
খালিদ বিন শাহিদ বয়সে তরুণ হলেও তার চিন্তায় বিচরণ করে প্রাজ্ঞতার ছাপ। তার জৈবনিক বাস্তবতা মিশ্রিত ছড়ার নন্দনতত্ত্ব যেকোনো পাঠককেই মুগ্ধ করবে। তার সৌকর্যমণ্ডিত ক্ষুরধার চিন্তা দিয়ে ব্যক্তিজীবনের নানামাত্রিক দুঃখ, হতাশা, ক্ষোভ, সমস্যা, সম্ভাবনা, স্বপ্নকে ছড়ায় চিত্রের মতো উপস্থাপন করেছে। এছাড়াও ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্মৃতিকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তার ভাষা বেশ সহজবোধ্য ও অন্তর জাগানিয়া। তার সৃজনীশক্তিতে বিচ্ছুরিত হয় বিশ্বাস ও বোধের সমন্বয়। মূলত যে জীবনকে মহাশক্তিধর প্রতিপালকের সামনে নত করার কথা, সেখানে মোহমায়া জীবনকে বামপথে ভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত করা, এটা খালিদের ভাষায় বেশ চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। ‘আসতে হলো দেরি’ ছড়ায় তার সহজিয়া উচ্চারণ-
‘তোমার কাছে আসতে আমার
হলো অনেক দেরি
তাইতো আমি ভীষণ লাজে
কেঁদে কেঁদে মরি।
একই ছড়ায় মহান প্রভুর প্রতি তার কর্তব্যবোধকে প্রকাশ করে বোধকে উন্মোচন করেছে। এতে তার মহান মনিবের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও সমর্পণ প্রকাশ পেয়েছে। তার ছড়ায়-
‘আজকে আমার বোধের উদয়
কিছু হলো বুঝি
তাইতো শেষে তোমার কাছে
একটু দয়া খুঁজি।’
ছড়াকার খালিদের জীবনে স্মৃতি এক প্রাণ জাগানিয়া প্রেরণা। এর সাথে ইচ্ছের সংমিশ্রণে প্রশান্তির অনুষঙ্গকেও উপস্থাপন করেছে সে। এটা ব্যক্তিমাত্রই আদর্শের অনুগামী করে তুলবে। তার ‘ভালো লাগে’ ছড়ায় লিখেছে-
‘ভালো লাগে যাই উড়ে
দূর বহুদূর
ভালো লাগে কোরানের
সুধা ভরা সুর।’
খালিদের ছড়ায় শেকড় যেন অস্তিত্বের এক শক্ত ভিত। এটা তার অনুধ্যানের খণ্ড খণ্ড চিন্তাকে মূলের মোড়কে সৌন্দর্যময় করে তুলেছে। এজন্য সে মাটিকেই আপন মনে করে। কারণ এ মাটিতেই তার বেড়ে ওঠা এবং এ মাটতেই অনন্তস্মৃতিকে মিশিয়ে দিতে হবে যা চিরন্তন বাস্তবতা। ‘মাটির রং’ ছড়ায় তার উচ্চারণ-
‘একটু যখন ক্লান্তি আসে
তিক্ত মুখের বোল
মাটির পরাগ গায়ে মেখে
ছাড়াই পুরান খোল।’
খালিদের ব্যক্তিবোধে ভালোবাসা এক এক স্বপ্নবিলাসী রঙ। এ রঙকে গায়ে মেখে পুরোনোকে নতুন করে ভাষা দেওয়া যায়। মূলত এই প্রেমের জন্যই তার প্রিয়জনের আগমনকে সে হৃদয়ের সুখ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। ‘আসলে যখন তুমি’ ছড়ায়-
‘হেসে যখন বললে কথা
ভেসে গেলাম দূর
ভালোবাসার গানে গানে
জাগলো মনের পুর।’
ছড়াকার খালিদের জীবনে ব্যক্তি কাতরতা এক তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রলেপ। এটা তার জীবন থেকে দেখা। তার পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিকে সে সৃষ্টির ভঙ্গিতে আবেগময় ভাষায় প্রকাশ করেছে ‘খরা’ ছড়ায়। তার ভাষায়-
‘ব্যথায় কাতর হয় যদি কেউ
কেউ না তারে দেখে
দুঃখে দুঃখে কাটায় সময়
ব্যথার প্রলেপ মেখে।’
স্মৃতি কখনো বেদনা, কাতরতা আর অস্থিরতার নাম। আবার কখনো প্রেরণার বাতিঘর। ছড়াকার খালিদের ভাষায় স্মৃতিকে মুছে ফেলাও খুনের সমতুল্য। এর মধ্যেও দার্শনিক প্রজ্ঞা লুকায়িত। ব্যক্তিমাত্রই স্মৃতিকে হত্যা করে খুনি হয়। ‘খুনি’ ছড়ায় সে লিখেছে-
‘হাজার হাজার স্মৃতির আমি
গলা কেটে দিয়ে
খুন করেছি অবলীলায়
স্মৃতির ঘরে গিয়ে।’
স্মৃতির ভারে, বেদনায় মূহ্যমান হয়ে ব্যক্তির হৃদয় পুড়ে ভস্ম হয়। বিরহে কাতর হৃদয় তখন দুঃখকে আপন করেই পথ চলে। তবে খালিদের ছড়ায় হৃদয় পোড়ার গন্ধ যেন তিক্ত অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতাকেই সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে তার ‘হৃদয় পোড়ার গন্ধ’ ছড়ায়। তার লেখায়-
‘হৃদয় পোড়ার গন্ধ যে আজ
মাতাল করে তোলে
তিক্ত অভিজ্ঞতা ছোঁয়ায়
ব্যথার দুয়ার খোলে।’
ছড়াকার খালিদের লেখায় প্রাণবন্ত হয় জীবে প্রেম। এ যেন মানবীয় কাচের স্বর্ণরেণু, যা তার সৃজনীশক্তিকে দিয়েছে সুশোভিত মন। এ মন একটি বিড়ালছানার প্রতি মমত্ববোধ প্রকাশে কার্পণ্য করে না। পাশাপাশি সৃষ্টির সেরাজীব মানুষের নিষ্ঠুরতার চিত্রকেও অংকন করে তার সৃজনে। ‘বিড়ালছানা’ ছড়ায় তার দরদি কথা-
‘মানুষ কেন পাষাণ হলো
বিড়ালছানার প্রতি
পাইনা খোঁজে জবাবটা ঠিক
মনটা কাঁদে অতি।’
এভাবেই প্রতিটি ছড়ায় তার বিচিত্র চিন্তা এবং বৈষয়িক প্রকরণ প্রতিভাত হয়েছে। বিচিত্র বিষয়কে ছড়ার মাধ্যমে উপস্থাপন তার বিশেষ শিল্পগুণ। এখানেও স্বপ্রতিভূ তার বয়সী মননী চর্চা। তার ছড়ার শব্দবুনন এবং গাঁথুনি একজন বয়সী ছড়াকারের ছড়ারই প্রতিচ্ছবি।
চার.
খালিদ বিন শাহিদ বর্তমানে ঢাকায় একটি কওমী মাদরাসায় মিশকাত জামাতে অধ্যয়ন করছে। উম্মাহর প্রেম ও কল্যাণকামী মনোভাব তার আদর্শে প্রতিভাত। মৌল দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারে ছড়াতেই এর স্বরূপ বিশ্লেষণ করা যায়। ছড়াগ্রন্থটির ৪০টি ছড়াই পাঠযোগ্য এবং আনন্দের খোরাক হবে নিঃসন্দেহে। অবাস্তব এবং অতি কল্পনাকে পরিহার-তার ছড়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য। জীবনঘনিষ্ঠতা ও বাস্তববাদিতায় পূর্ণ ছড়াগুলো পাঠক হৃদয়কে ব্যাকুল করে তুলবে সৃষ্টির উন্মাদনায়। ছন্দ, মাত্রা, অন্ত্যমিল এবং কাঠামোর নির্মাণশৈলিতে বয়সী সচেতন সে। এজন্য পাঠকের কোথাও হোঁচট খাওয়া কিংবা বাধাগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ নেই। প্রতিটি ছড়াই হৃদয় থেকে উৎসারিত বিধায় ব্যক্তির হৃদয়ের সাথেই এর যোগসূত্রতা। তার চিন্তা ও চেতনায় দক্ষতার কারুকাজ এমনই পরিস্ফুটিত হয়েছে যে, তার সম্ভাবনাকে প্রকট করে তুলেছে। সাহিত্যাঙ্গনে তার সরব উপস্থিতি তাকে একজন প্রতিশ্রুতিশীল ছড়াকার হিসেবে গণ্য করবে। আমি তার ব্যক্তি ও সাহিত্যজীবনের কল্যাণকামী।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও সাহিত্য সমালোচক

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2016 Paprhi it & Media Corporation
Developed By Paprhihost.com
ThemesBazar-Jowfhowo