আমাদের দেশের অধিকাংশ নারীকে তাদের বাবা এবং স্বামীর সম্পত্তি থেকে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত করা হয়। এর উপর রয়েছে শ্বশুড়বাড়িতে যৌতুকের নিত্যনতুন চাহিদার ফর্দ। এ ক্ষেত্রে নিম্নবিত্ত আর উচ্চবিত্তের মাঝে ফারাক সামান্য। ফলে নারীরা চরম অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এ কারণে নারীদের অধিকহারে কর্মসংস্থান অপরিহার্য। আমরা সবাই জানি, গত দুই বছর ধরে করোনার অতিমারিতে বিশ্বে বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, তেমনি কোটি কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক ধ্বস নেমেছে। কোটি কোটি মানুষ চাকুরি হারিয়েছে, বেতন কমেছে, ব্যবসা বাণিজ্যে লোকসানসহ প্রতিটি সেক্টরে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে দেখা গেছে, উপার্জনক্ষম স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কারো ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়লে অন্যজন তা সামলে নিতে সক্ষম হয়েছে। করোনাকালের এই বাস্তবতাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, নারীদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা সংসারের দুর্দিনে আর্শীবাদস্বরূপ।
আর্থিক অবস্থান বিবেচনায় আমাদের দেশে নারীদের চার শ্রেণিতে ভাগ করা যায়- উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত। এই শ্রেণিবিভাগ থাকলেও সবশ্রেণির নারীদের শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস কমবেশি অভিন্ন, যদিও বিগত কয়েক দশকে আমাদের দেশের নারীসমাজ শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, ব্যবসা বাণিজ্য, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ বিভিন্ন সেক্টরে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় নারীর অবস্থান অনেক সুসংগঠিত হয়েছে।
একজন কর্মজীবী নারী মূলত তার বেতন বা পারিশ্রমিক সংসারের স্বচ্ছলতা আনতে ব্যয় করে। কর্মজীবী নারী যদি অবিবাহিত হয়, তাহলে সে নিজের ব্যয় নির্বাহের পাশাপাশি মা-বাবা, ভাইবোনকে প্রয়োজনে সাহায্য করতে পারে। কিছু অংশ সঞ্চয় করতে পারে। অপরদিকে একজন বিবাহিত নারী যদি কর্মজীবী হয়, তাহলে সে স্বামীর পাশাপাশি সংসারে তার আয়ের অংশ খরচ করতে পারে। নিজের কিছু কিছু চাহিদার জন্য সবসময় স্বামীর কাছে হাত না পেতে ইচ্ছানুযায়ী খরচ করতে পারে। সন্তানের কোনো বাড়তি চাহিদা থাকলে, তা মেটাতে পারে। তদুপরি কর্মজীবী নারীরা তাদের বেতনের একটা অংশ সঞ্চয় করতে পারে।
এর বিপরীতে আমাদের সমাজে দেখা যায় ভিন্ন চিত্রও। একজন কর্মজীবী নারী কি আসলেই সম্পূর্ণ আর্থিক স্বাধীনতা ভোগ করে? তার অর্জিত আয় কি তিনি ইচ্ছামতো খরচ করতে পারেন? অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা দেখি, যারা বিবাহিত, সেসব কর্মজীবী নারীদের বেতনের উপর রয়েছে স্বামী এবং শ্বশুড়বাড়ির অলিখিত খবরদারিতা। এক্ষেত্রে হয়তো অনেকের অভিমত স্বামী-স্ত্রী দু’জনই দু’জনের উপার্জিত অর্থের উপর সমান দাবিদার। কিন্তু কয়জন স্বামী তার স্ত্রীর হাতে বেতনের সম্পূর্ণ অংশ তুলে দেন? এমনকি অধিকাংশ স্বামীই তার স্ত্রীর কাছে কত বেতন পান, তার কোনো সঠিক তথ্য জানান? এমনও দেখা যায়, স্বামীর কাছে নিজের ব্যক্তিগত খরচের টাকা পান না বলে অনেক স্ত্রী রোজগারের পথে পা বাড়ান।
বিভিন্ন সমীক্ষায় বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধির জন্য কর্মজীবী নারীদেরকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী করা হচ্ছে। এ কথা সত্য, আর্থিক স্বাধীনতা নারীকে দিয়েছে আত্মনির্ভরশীলতা, সম্মান, সামাজিক মর্যাদা, সর্বোপরি সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা। তাই স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করার দিন থেকে নারী বের হয়ে আসছে ক্রমেই। এমনকি সন্তানের দায়িত্ব ও ভরণপোষণ একক কাঁধে তুলে নিতেও নারী আর কুণ্ঠিত নন। সমাজের একটি বড় অংশ নারীদের এই পরিবর্তনকে নেতিবাচক দিকটাই দেখছে। তারা ভুলে যায়, একজন নারী, একজন স্ত্রী এবং সর্বোপরি একজন মা। তিনি কখনো চান না, তার সন্তান পিতার স্নেহ ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হোক। সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে সব মা-ই সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যান সংসার টিকিয়ে রাখতে। নিতান্ত অপারগ না হলে, সহ্যের সীমা অতিক্রম না করলে নারী বিচ্ছেদের পথে পা বাড়ান না। এক্ষেত্রে আসলে আমাদের অনেকের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গিই দায়ী। তারা এটা বুঝতে চায় না, নারী এখন অনেক বেশি সচেতন। নিজের ভালো-মন্দ বুঝে নিতে সক্ষম।
নারীর সম্মানবোধের শিক্ষা মূলতঃ পরিবারেই নিহিত। সন্তানরা তাদের পরিবার থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি মূল্যবোধ, নৈতিকতা, শিষ্টাচারের শিক্ষা নেয়। তাই সব পিতামাতারই তাদের সন্তানদের নারীদের প্রতি সম্মান, মর্যাদাবোধের শিক্ষা দেয়া উচিত। শুধুমাত্র ছেলে-সন্তানকেই না, কন্যাসন্তানকেও এমনভাবে গড়ে তোলা উচিৎ যেন সে আত্মনির্ভরশীল, সহানুভূতিশীল ও স্বকীয়তাবোধ সম্পর্কে শৈশব থেকেই সচেতন হয়। জীবনে চলার পথ যে কতো বন্ধুর, সে সম্পর্কে সন্তানদের পরিবার থেকেই ধারনা এবং বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সক্ষমতা অর্জন করতে শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের মনে মানবিক গুণাবলীর সন্নিবেশ ঘটাতে হবে। তাহলে সন্তানরা প্রকৃত মানুষ হিসেবে সমাজে নিজেদের তুলে ধরতে পারবে।
এ কথা সত্য, সমাজ-সভ্যতায় নারীর অগ্রযাত্রার সংগ্রাম নারীর একার নয়। নারীর নিজেকে জয় করার চ্যালেঞ্জে পুরুষদেরও সহযোগিতা ও সহায়তা প্রয়োজন। তাই সমাজের সার্বিক অগ্রসরতা ও সচেতনতা বৃদ্ধিই এ চ্যালেঞ্জ জয়ের অন্যতম নিয়ামক শক্তি। এই শক্তি অর্জনের লক্ষ্যে সমাজের সকল অংশের সমানতালে সম্মিলিত লড়াই প্রয়োজন।