২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ সকাল ১১:৪২

ঐতিহাসিক পলাশী দিবস : ইতিহাসের ভয়ঙ্কর এক কালো অধ্যায়

কামরুল আলম
  • আপডেট বৃহস্পতিবার, জুন ২৩, ২০২২,

২৩ জুন ঐতিহাসিক পলাশী দিবস। ১৭৫৭ সালের এই দিনে ভাগীরথী নদী তীরে পলাশীর আমবাগানে নবাবের বাহিনীর মুখোমুখি হয় ইংরেজ বাহিনী। যুদ্ধের নামে এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পরাজিত হন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজ উদ-দৌলা। এই পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য। ঐতিহাসিক পলাশী দিবস তাই ইতিহাসের ভয়ঙ্কর এক কালো অধ্যায়।
.
১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল সিরাজ উদ-দৌলা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আসীন হন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২২ বছর। তরুণ নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের বিভিন্ন কারণে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, নবাব সিরাজ উদ-দৌলার নানা আলীবর্দী খান ইন্তেকাল করেন ১৭৫৬ সালের ৯ এপ্রিল। আর পলাশী যুদ্ধে সিরাজের পতন ঘটে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, অর্থাৎ ১৪ মাস ১৪ দিন পর। নানামুখী ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে সিরাজ উদ-দৌলাকে টিকে থাকতে হয়েছে। কিশোর সিরাজউদ্দৌলা ক্ষমতায় বসার পর এই ১৪ মাসে কমপক্ষে ১২০০ মাইল দুর্গম পথ তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে। সে সময়ে কোনো উন্নত যানবাহন ছিল না। পাঁচ, পাঁচটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে। চর্তুদিকে অসংখ্য ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে হয়েছে। তাকে তো আলেকজান্ডারের চেয়েও দ্রুত গতিতে পথ চলতে হয়েছে। রাত কাটাতে হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে ও অশ্বপৃষ্ঠে। দিন কাটাতে হয়েছে ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে। নানাজীর উদ্যোগে সেই অল্প বয়সে বিবাহিত সিরাজের তখন আপন স্ত্রী লুৎফা, শিশু কন্যা জোহরার প্রতি ফিরে তাকাবারও ফুরসত ছিল না।
.
পলাশী যুদ্ধে পরজয়ের মূল কারণ কী তা সঠিকভাবে আজও আমাদের জানা নেই। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এই যে, পলাশী যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের মাত্র তিন হাজার ২০০ সৈন্যের কাছে সিরাজউদ্দৌলার ৫০ হাজার সৈন্যের অভাবনীয় পরাজয় ঘটে। আশ্চার্যজনক ব্যাপার একটা দেশের হাজার হাজার সৈন্য পরবর্তীতে কোথায় গেল? পলাশী যুদ্ধের মাত্র তিন-চার বছরের পরে মীর কাশিমের কাটোয়া, গিরিয়া, উদয়নালার যুদ্ধে অথবা দিনাজপুর ও রংপুরকে কেন্দ্র করে নূরুল দিন ও ফকির মজনু শাহের যে প্রতিরোধ সংগ্রাম সেখানেও এসব সৈন্যের ঐক্যবদ্ধ লড়াই দেখতে পাওয়া যায়নি। সে সময় বাঙলার নবাব মীর জাফরকে সবাই ক্লাইভের গর্দভ বলে জানতেন। শেষ মহূর্তে বাংলার মানুষেরা কেন তখন সেই গর্দভের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। পলাশীর প্রান্তরে ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া প্রেক্ষাপটে আজ আমাদের গভীরভাবে নতুন করে উপলব্ধি করতে হবে।
.
পলাশী যুদ্ধ সম্পর্কে রবার্ট ক্লাইভ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, সে দিন স্থানীয় অধীবাসীরা ইংরেজদের প্রতিরোধ করতে চাইলেই লাঠিসোটা আর হাতের ইটপাটকেল মেরেই তাদের খতম করে দিতে পারতো। কিন্তু এ দেশবাসী তা উপলব্ধি করতে পারেনি। যেকোনো কারণেই হোক সে দিন বাংলার মানুষ এগিয়ে আসেনি। তাদের রাজনৈতিক সচেতনতার তখন খুবই অভাব ছিল। পলাশীর ট্র্যাজেডির পরেও বাংলার সাধারণ মানুষ, কৃষক সমাজ দৈনন্দিন জীবন, নিত্যদিনের মতোই মাঠে কৃষি কাজ করেছে। ফসল বুনেছে। অথচ পলাশীর যুদ্ধে গোটা জাতীয় জীবনে কী নিদারুণ ভাগ্য বিপর্যয় ঘটলো, এক ঘণ্টার প্রহসন যুদ্ধে গোটা জাতির স্বাধীনতা হরণ করে নিয়ে গেল গোটা কয়েক বেনিয়া ইংরেজ অথচ তাদের টনক নড়লো না। টনক যখন নড়লো, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাদের আর তখন কিছুই করার ছিল না। সিরাজউদ্দৌলা কখনও তার দেশের প্রজাদের সাথে কোনো অবস্থাতেই বিশ্বাস ঘাতকতা করেননি। কখনও স্বেচ্ছায় স্বদেশকে বিকিয়ে দেননি। পলাশীর প্রান্তরে মর্মান্তিক নাট্যমঞ্চে এক মাত্র তিনি ছিলেন মূল নায়ক। সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলার স্বাধীনতার শেষ প্রতীক।
.
যারা ষড়যন্ত্র করে নবাব সিরাজ উদদৌলাকে হত্যা করেছিল, তাদের অনেককেই অস্বাভাবিকভাবে মরতে হয়েছে।সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করেছিল মোহাম্মদী বেগ মীরণের নির্দেশে। মোহাম্মদী বেগ উন্মাদ অবস্থায় দাম্পত্য কলহে এক কূপে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। মীরণের মৃত্যু ঘটেছিল বজ্রপাতে। সিরাজের খালা ষড়যন্ত্রকারী ঘসেটি বেগমকে মীরণ বুড়িগঙ্গার প্রবল খরস্রোতা নদীতে নৌকা ডুবিয়ে মেরে ফেলে। মীর জাফর ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে দু’দুবার বাংলার মসনদে বসেছিলেন। কিন্তু শেষ বয়সে মারাত্মক কুষ্ঠ ব্যধিতে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়। মীর কাশিম আলী খান পরবর্তীতে বাংলার নবাব হয়েছিলেন; কিন্তু শুরুতেই তিনি ছিলেন বাংলার মুসিলম শাসন অবসানের মূল ষড়যন্ত্রের অন্যতম সহযোগী। ভগবান গোলায় নবাবকে তিনি সর্বপ্রথম ধরিয়ে দেন তার শ্যালক মীরণের হাতে। শেষ পর্যায়ে এসে মীর কাশিম অনুধাবন করলেন একদা এই চক্রের সাথে হাত মিলিয়ে তিনি বাংলার মুসলমানদের স্বার্থের চরমতম ক্ষতিই সাধন করেছেন এখন আর কোনো উপায় নেই। মীর কাশিম বুঝলেন ঠিকই, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু মূল ষড়যন্ত্রকারীরা কি চিরকালই পর্দার অন্তরালে থেকে যাবে? মুঙ্গেরের দুর্গশীর্ষ থেকে বস্তায় ভরে তিনি নিক্ষেপ করেন জগৎশেঠ আর রায়দুর্লভের জীবন্ত দেহ গঙ্গার বুকে। অপর এক অপঘাতে নিহত হলো রাজা রাজ বল্লভ। পরবর্তীকালে তার সব কীর্তি পদ্মা নদীর গ্রাস করে কীর্তিনাশা নামধারণ করলো। কিন্তু এত করেও মীর কাশিম তার শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর ইংরেজ কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে বনে জঙ্গলে আত্মগোপন করেই রইলেন। জঙ্গলেই তার দুই ছেলে নিহত হন। নির্বংশ মীর কাশিম আলী খান এরপর কোথায় উধাও হয়ে যান ইতিহাস সে সম্পর্কে নীরব।
.
২৩ জুন এক ভয়ঙ্কর কালো দিবস। দিনটি যেমন ঘৃণিত তেমনি এক শিক্ষণীয় দিবসও আমাদের জন্য। পলাশী দিবস আমাদেরকে এই শিক্ষাই দিয়ে যায় যে, দেশের ভেতরের শত্রুরা বাইরের শত্রুর চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। পলাশীর ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যমলা সোনার বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের নিকট থেকে দেশকে রক্ষা করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2016 Paprhi it & Media Corporation
Developed By Paprhihost.com
ThemesBazar-Jowfhowo