হুমায়ুন আজাদ তার আধুনিক বাঙলা কবিতা সঙ্কলন থেকে বাদ দেন সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ও আবদুল মান্নান সৈয়দকে এই অজুহাতে যে, যেহেতু তারা তথাকথিত প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার পরিপন্থী, সুতরাং তাদের কবিতা আধুনিক বাঙলা কবিতার সঙ্কলনে থাকার উপযুক্ত নয়। আচরণটা নির্বোধ হিংসুটে বালকের মতো অনেকটা, যাকে কেবল উপেক্ষা কিংবা করুণাই করা যায়।
সূর্যের বিরুদ্ধে পেঁচার অভিযোগের কোনো শেষ নেই, তাতে সূর্যের সূর্যখ্যাতি এক চুলও কিন্তু নড়চড় হয় না; এখানেই আমাদের স্বস্তি।
একজন মানুষের নানা ক্ষেত্রে অবদান রাখার ক্ষমতা থাকে। কেউ হয়তো ভালো গাইতে পারেন, ভালো আঁকতে পারেন, ভালো আবৃত্তি করতে পারেন, সেই সাথে ভালো রাঁধতেও পারেন। একসাথে এতগুলো যোগ্যতা থাকার পরও তিনি কিন্তু সব বিষয়ে সমানভাবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন না, একটি বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেন। যেমন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রচুর লেখালেখি রয়েছে এবং সেসব ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট সফলও। তারপরও মানুষ রবীন্দ্রনাথকে মূলত কবি হিসেবেই ভাবতে পছন্দ করেন, বলতেও পছন্দ করেন। নজরুলের ক্ষেত্রেও একই কথা। বাকি সব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি কবি। নাটকেও টিএস এলিয়টের সাফল্য কিন্তু একেবারে ফেলনা নয়, কিন্তু কয়জন লোক যখন বলে তখন এলিয়ট কবি-এলিয়ট না বলে নাট্যকার-এলিয়ট বলে? ডি এইচ লরেন্স ভালোমানের কবিতাও লিখেছেন, কিন্তু গল্পকার কিংবা ঔপন্যাসিক হিসেবেই তিনি খ্যাতি পেয়েছেন সারা বিশ্বে। সৈয়দ আলী আহসানেরও নানা খ্যাতি ও পরিচয় ছাপিয়ে একটি পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাভাষায়, তাহলো কবি সৈয়দ আলী আহসান।
চল্লিশের দশকে শক্তিশালী কবিদের একজন সৈয়দ আলী আহসান। বাংলা কবিতায় তাঁর কণ্ঠস্বর সম্পূর্ণ নতুন এবং সবার থেকে স্বতন্ত্র। কিন্তু ত্রিরিশের দশক থেকে একটা মজার ব্যাপার বাংলা ভাষায় পরিলক্ষিত হয়ে আসছে যে, নানা কৌশলে ও চতুরতায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল কবিরাই এখানে সদর্পে নেতৃত্বের আসনে আসীন। এর পেছনে যে দু’টি কলকাঠির ভূমিকা মুখ্য, তাহলো তথাকথিত প্রগতিশীল রাজনীতি এবং এ শ্রেণীর রাজনীতির আদর্শে লালিত বেশ কিছু পত্রপত্রিকা। নানা মিডিয়ায় এরা প্রচার করতে থাকে যে, অমুক অমুক এই এই সময়ের একমাত্র মৌলিক লেখক-কবি। বারবার এক কথা প্রচারিত হতে হতে পাঠকদেরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে যায় তা। তখন আর তাকে খবর করার মতো থাকে না কেউ।
বুদ্ধদেব বসু তার আধুনিক বাংলা কবিতা সঙ্কলন থেকে অহেতুক অনেককে ছাঁটাই করেন। হুমায়ুন আজাদ তার আধুনিক বাঙলা কবিতা সঙ্কলন থেকে বাদ দেন সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ও আবদুল মান্নান সৈয়দকে এই অজুহাতে যে, যেহেতু তারা তথাকথিত প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার পরিপন্থী, সুতরাং তাদের কবিতা আধুনিক বাঙলা কবিতার সঙ্কলনে থাকার উপযুক্ত নয়। আচরণটা নির্বোধ হিংসুটে বালকের মতো অনেকটা, যাকে কেবল উপেক্ষা কিংবা করুণাই করা যায়।
সূর্যের বিরুদ্ধে পেঁচার অভিযোগের কোনো শেষ নেই, তাতে সূর্যের সূর্যখ্যাতি এক চুলও কিন্তু নড়চড় হয় না; এখানেই আমাদের স্বস্তি। সৈয়দ আলী আহসানের বিরুদ্ধে পেঁচাদের বাক্যবাণ ভোঁতা হয়ে যাবে; তিনি তাঁর স্বকীয় সত্তায় যে রকম প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তাঁর জীবদ্দশায়, তেমনই প্রতিষ্ঠিত থাকবেন চিরদিন, যত দিন থাকবে বাংলাদেশ আর বাংলা ভাষা, আর কোনো কারণে না হোক, তার বেশ কিছু কবিতার কারণে অন্তত।
তার আগে জানা প্রয়োজন সৈয়দ আলী আহসান কবিতা সম্পর্কে কী বিশ্বাস পোষণ করতেন অন্তরে, কবিতা বলতে তিনি বুঝতেনই বা কী। তার উচ্চারণ কাব্যগ্রন্থে ১৮ নম্বর কবিতাটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। একটি নিরেট গদ্যকবিতা এটি, টানা গদ্যে লেখা :
‘যে পৃথিবীতে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ভেঙে গেছে এবং যেখানে মানুষের পদক্ষেপ অর্থহীনতায় যেন উৎসর্গীকৃত সেখানে শৃঙ্খলিত সূরের সম্মোহন কি করে আসে? সেখানে কবিতা বিচিত্র ভঙ্গুর শব্দচূর্ণের উদ্যমহীন সমস্বর।
আমি যদি কখনো মহাকাব্য লিখি, সে মহাকাব্যে ঘটনার শাসনে নিয়ন্ত্রিত কোনো কাহিনী থাকবে না; সেখানে ইতিহাসের অংশ, অতর্কিত চিন্তার সংশয়, স্মৃতির অনুরণন, ধর্ম নির্দেশের নিষ্পেষণে আত্মার আর্তনাদ একসঙ্গে কথা বলে উঠবে।
আবেগ যদি চিন্তার দ্বারা সমর্থিত না হয় এবং বুদ্ধির দ্বারা পরিশোধিত না হয়, তবে সে আবেগ কুহেলিকাই সৃষ্টি করতে পারে, জীবনের সম্ভাবনা জাগায় না। তাই শুধু আবেগের ওপর নির্ভরশীল যেসব কবিতা তাতে কোনো বিস্ময় নেই।’
সৈয়দ আলী আহসান তার এই কবিতা দ্বারা পাঠকদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তার কবিতা নির্ভেজাল আবেগের আধার নয়। তার কবিতায় পাঠক খুঁজে পাবে আবেগ, কল্পনা ও বুদ্ধি এই তিনের মেলবন্ধন। নিরেট আবেগ-নির্ভর নয় বিধায় তার কবিতা অসম্ভব রকমের শান্ত ও সুন্দর। তার কবিতায় ঢেউ আছে, সে ঢেউয়ে তীর ভাঙে না; শব্দ আছে, সে শব্দ নিছক চিৎকার নয়, গীতল ও মধুর; এবং আলোও আছে, সে আলো হেজাকের মতো প্রখর না, জোনাকির মতো কোমল ও কমনীয়।
আমার পূর্ব বাংলা বাংলা ভাষায় সম্পূর্ণ একটি নতুন ধরনের কবিতা। এর নতুনত্ব দুই দিক দিয়ে; এক. মেজাজে, দুই. দেহসৌষ্ঠবে। কী এক আশ্চর্য সম্মোহনী শক্তি রয়েছে এর সর্বাঙ্গে। যখন কবিতাটি শুরু হয় এইভাবে :
আমার পূর্ব বাংলা কি আশ্চর্য /
শীতল নদী
অনেক শান্ত আবার সহসা
স্ফীত প্রাচুর্যে আনন্দিত
একবার কোলাহল, অনেকবার
শান্ত শৈথিল্য
আবার অনেকবার স্মিমিত কণ্ঠস্বরের
অনবরত বন্যা
কতবার বক আর গাঙশালিক
একটি কি দু’টি মাছরাঙা
অবিরল কয়েকটি কাক
বাতাসে বাতাসে প্রগলভ কাশবন
ঢেউ ঢেউ নদী প্রচুর কথার
কিছু গাছ আর নারকেল শন পাতার
ছাউনির ঘর নিয়ে
এক টুকরো মাটির দ্বীপ
তখন শ্রোতা হতভম্ব হয়ে থেমে যান, হরিণের মতো কান খাড়া করে দিয়ে পরম কৌতূহলে শুনতে থাকেন একগুচ্ছ শব্দের আওয়াজ আর মর্মার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট হন, ততই তিনি নুড়ির মতো এক নিবিড় ভালোবাসায় তলিয়ে যেতে থাকেন তার দেশের অথৈ সৌন্দর্যে। আঁকাবাঁকা রেখার মতো সাজানো কবিতার চরণগুলো দেখে, প্রথম দোলাতেই মনে হয়, কবিতাটি বোধ হয় নিখুঁত ছন্দ দিয়ে গাথা অথচ একটু খেয়াল করলেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কবি প্রচলিত কোনো ছন্দের স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, কি অক্ষরবৃত্ত আশ্রয় নেননি এখানে। তারপরও কোনো দুর্মূর্খের একথা বলার স্পর্ধা নেই যে, কোনো ছন্দ নেই এ কবিতায়।
আমার পূর্ব বাংলায়ও একটি ছন্দ আছে, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন কানের ছন্দ। অথবা একে বলা যায় গাছের ছন্দ। অরণ্যের গাছগুলো প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে এলোপাতাড়ি সাজানো অথচ কী সুন্দর! বাংলা কবিতায় আমার পূর্ব বাংলার অনুপ্রবেশ এভাবে নতুন মেজাজে, যে মেজাজ রবীন্দ্রনাথের থেকে আলাদা, নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশ থেকেও ভিন্ন; এবং অন্য যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয় তাহলো, এর প্রচলিত ছন্দ ভেঙে দেয়ার ছন্দ।
সৈয়দ আলী আহসানের কবিতা আমরা পড়ি না, যেন কেবল কিছু শব্দের আওয়াজ শুনি, তন্ময় হয়ে শুনি আর অনুভব করি সম সত্তা দিয়ে, কবি যখন এভাবে বলেন :
আমার পূর্ব বাঙলা বর্ষার অন্ধকারের
অনুরাগ
শরীর ছুঁয়ে যাওয়া
সিক্ত নীলাম্বরী
নিকুঞ্জের তমাল কনক লতায় ঘেরা
কবরী এলো করে আকাশ দেখার
মুহূর্ত
অশেষ অনুভূতি নিয়ে
পুলকিত সচ্ছলতা
এক সময় সূর্যকে ঢেকে
অনেক মেঘের পালক
রাশি রাশি ধান মাটি আর পানির
যেমন নিশ্চেতন করা গন্ধ
কত দশা বিরহিনীর-এক দুই তিন
দশটি
আমার পূর্ব বাংলার মতো সফল সুন্দর, সৈয়দ আলী আহসানের নিজস্ব ঢঙের অনেক কবিতা রয়েছে তাঁর একক সন্ধ্যায় বসন্ত, সহসা সচকিত, উচ্চারণ, আমার প্রতিদিনের শব্দ, সমুদ্রেই যাবো প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে। তার একক সন্ধ্যায় বসন্ত সবচেয়ে সফল কাব্যগ্রন্থে বলা যায়। এটাই তার প্রথম সফল গ্রন্থে, যেখানে তার নিজস্ব কবিসত্তা নতুন বাঁক নিয়ে নানা রঙ, নানা সুর ও নানা ছন্দের অপূর্ব সমাবেশ ঘটিয়েছে। সৈয়দ আলী আহসান যে আপাদমস্তক একজন কবি, তা তার কণ্ঠ শুনলেই অনুধাবন করা যায়। উচ্চারণ কাব্য¯্রন্থের ৩৪ নম্বর কবিতাটি পাঠক লক্ষ করুন:
তোমাকে আমার শস্যক্ষেত্র
করবো ভেবেছিলাম
যেখানে প্রথম মানুষের
আনন্দকে বপন করবো
আমার দেহের উজ্জ্বল হাসিতে
তোমার শস্যভূমি নাচবে।
তোমার সুগন্ধ কেশ থেকে
সূর্যকণা ঝরে পড়তো।
কিন্তু কেন তুমি হঠাৎ ছায়া ফেলবে?
এবং আমাকে
মৃতদেহের মতো বরফের পাথর করলে?
এরপর তুমি যখন
আমার সন্ধান করবে,
তখন আমার কবরের মধ্যে
মাথা রাখবার জন্য
একটি শুকনো হাড় পাবে,
যা একদিন আমার বাহু ছিলো।
সৈয়দ আলী আহসান মানুষ ও তার জীবনকে দেখেছেন অত্যন্ত সূক্ষ্ম চোখে। তার চোখ বড় তীর, যা সহজেই অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ফুঁড়ে অনন্তে পৌঁছে যায়। জীবনকে পাঠ করেছেন তিনি নানা আলোয়, নানা আঙ্গিনায়, যে কারণে জীবন ও জগতের ঘটে যাওয়া নানা ট্র্যাজেডিও তার কবিতায় শিল্পের আকার ধারণ করে। তার সফল কবিতাগুলোর একটি সমুদ্রেই যাবো কাব্যগ্রন্থের ‘উরিরচর’। কবি যখন এভাবে বলেন:
রাত্রিতে হারিকেন জ্বালিয়ে তারা শুয়েছিলো
শোবার আগে হেসেছিল এবং প্রদীপের শিখা
বাতাসের গান স্মরণ করেছিলো। কি করে
অন্ধকার হতে হয় রাত্রি তা জানতো এবং
বনভূমি জানতো কি করে রহস্যময় হতে হয়।
এবং ঘুমুতে যাবার আগে মানুষগুলো জানতো
কি করে গায়ে চাদর টেনে দিতে হয়।
তখন উরিরচরের হতভাগ্য মানুষগুলো বিশ্বের মানুষ হয়ে ওঠে এবং তাদের মৃত্যু পৃথিবীর অসহায় মানুষের অদৃষ্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
সৈয়দ আলী আহসান জানতেন কী করে কবিতাকে একটি সফল কবিতা হয়ে উঠতে হয়। যেহেতু তিনি আবেগ-নির্ভর কবিতা লিখতে পছন্দ করতেন না, স্বাভাবিকভাবেই তার কবিতাতে রয়েছে বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার প্রয়োগ : এজন্য তার কবিতা যেকোনো পাঠকের কাছে দাবি করে তার সম মনোযোগ। মনোযোগ দিয়ে কবিতা পাঠ করার মতো পাঠকের আজ বড্ড অভাব। কিন্তু যেভাবেই হোক, সৈয়দ আলী আহসানকে যারা জানতে ও বুঝতে চান, তাদেরকে তাকে বুঝতে হবে তার কবিতার মাধ্যমে, যেহেতু তার আসল পরিচয় তিনি কবি।