আম পাকে বৈশাখে, কুল পাকে ফাগুনে
কাঁচা ইট পাকা হয় পোড়ালে তা আগুনে
রোদে জ্বলে টিকে রঙ পাকা কই তাহারে
ফলারটি পাকা হয় লুচি দই আহারে।
হাত পাকে লিখে লিখে, চুল পাকে বয়সে
জ্যাঠামিতে পাকা ছেলে বেশি কথা কয় সে
লোকে কয় কাঁঠাল সে পাকে নাকি কিলিয়ে?
বুদ্ধি পাকিয়ে তোলে লেখাপড়া গিলিয়ে!
কান পাকে ফোড়া পাকে, পেকে করে টন্ টন্-
কথা যার পাকা নয়, কাজে তার ঠন্ ঠন্
রাঁধুনী বসিয়া পাকে পাক দেয় হাড়িতে
সজোরে পাকালে চোখ ছেলে কাঁদে বাড়িতে।
পাকায়ে পাকায়ে দড়ি টান হয়ে থাকে সে
দুহাতে পাকালে গোঁফ তবু নাহি পাকে সে।
উপরোক্ত ছড়াটির নাম ‘পাকাপাকি’। চমৎকার এই ছড়াটি লিখেছেন বাংলা শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছড়াকার সুকুমার রায়। তিনি ১৮৮৭ সালের ৩০ অক্টোবর কলকাতার ১৩নং কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ভাড়াবাড়িতে জš§গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায় ছিলেন শিশুসাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ। মায়ের নাম বিধুমুখী দেবী। বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিকের সন্তানও বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক। ছেলেবেলায় সুকুমারের ডাকনাম ছিল তাতা। আর ছদ্মনাম ছিল ‘উহ্যনাম প-িত’। কলেজ জীবনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ননসেন্স ক্লাব, যার মুখপত্র ছিল হাতে লেখা, নাম ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’। কলকাতায় লেখাপড়া শেষে ‘ফটোগ্রাফি অ্যান্ড প্রিন্টিং’-এ উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। ১৯২৩ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন খ্যাতিমান এই শিশুসাহিত্যিক।
ছেলেবেলা থেকেই দারুণ দারুণ ছড়া লিখতেন সকুমার। ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় লিখেছেন নিয়মিত। মৃত্যুর কিছুদিন পরেই ১৯২৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় সুকুমার রায়ের প্রথম ছড়াগ্রন্থ ‘আবোল তাবোল’। বাংলা শিশুসাহিত্যে এর আগে এরকম চমৎকার ছড়া আর কেউ লিখতে পারেননি! তোমরা কি তাঁর লেখা ‘বাবুরাম সাপুরে’ ছড়াটি পড়েছো? এসো আরেকবার পড়ি-
বাপুরাম সাপুরে / কোথা যাস বাপুরে? / আয় বাবা দেখে যা! /
দুটো সাপ রেখে যা! / যে সাপের চোখ্ নেই, / শিং নেই নোখ্ নেই, / ছোটে না কি হাঁটে না, /কাউকে যে কাটে না, / করে নাকো ফোঁস ফাঁস, / মারে নাকো ঢুঁশ ঢাঁশ, / নেই কোনো উৎপাত, / খায় শুধু দুধ ভাত- / সেই সাপ জ্যান্ত / গোটা দুই আন তো? / তেড়ে মেরে ডান্ডা / করে দিই ঠা-া।
বাংলা সাহিত্যে ননসেন্স রাইমের উদ্ভাবক তিনি। তাঁর লেখায় রামগরুড়–রের ছানা থেকে হুঁকোমুখো হ্যাংলা, কুমড়ো পটাশ থেকে ট্যাঁশ গরু- সবকিছুই সুনিপুণভাবে ফুটে উঠেছে। বিয়ের পাত্র হিসেবে সৎপাত্র গঙ্গারামের যে অসাধারণ বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তার জুড়ি মেলা ভার। শিশু-কিশোরদের জন্য কেবল ছড়া লিখেই দায়িত্ব শেষ করেননি তিনি। লিখেছেন মজার মজার সব গল্প। যে গল্পগুলো পড়লে ছোটোদের হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়। ছড়া এবং গল্পের পাশাপাশি তিনি লিখেছেন চমৎকার সব জীবনী ও প্রবন্ধ যা পড়ে শিশু-কিশোর বন্ধুরা উপকৃত হয়, জানতে পারে অনেক কিছু। মাত্র ৩৭ বছর বয়সেই সুকুমার রায় চলে গেছেন আকাশের তারা হয়ে। কিন্তু পৃথিবীর সাহিত্যাকাশে এখনও তিনি একটি জ্বলন্ত তারা। বাংলা শিশুসাহিত্য কিংবা ছড়াসাহিত্য দুটোতেই রয়েছে সুকুমার রায়ের বিশাল অবদান। সুকুমার রায়কে বাদ দিয়ে বাংলা শিশুসাহিত্য কিংবা ছড়াসাহিত্যের কথা কল্পনাও করা যায় না।