৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ দুপুর ২:৪৫

আল ফরহাদ-এর ছন্দে গাঁথা মনের খাতা

কামরুল আলম
  • আপডেট সোমবার, আগস্ট ২৪, ২০২০,
  • 3907 বার পঠিত

ঘুমের মধ্যে আছি আমি, সে যে গভীর ঘুম
হঠাৎ করে স্বপ্নে দেখি, অন্ধকার এক রুম
ছোট্টরুমে কেউ নেই আর, কেবল আমি একা
ঘুটঘুটে অই অন্ধকারে আর কারো নেই দেখা।

হাত বাড়ালাম অন্ধকারেই, দরজাটা যেই খুঁজি
দরজা কোথায়, বদ্ধঘরে, আটকে আছি বুঝি!
জানলাও নেই, দরজাও নেই, সঙ্গেও নেই কেহ
সাদাকাপড় পরে আছে আমার নিথর দেহ।
(কবর ঘর ।। পৃ.১৯)

আলোচ্য পদ্যাংশটি তরুণ কবি আল ফরহাদ-এর সম্প্রতি প্রকাশিত ছন্দে গাঁথা মনের খাতা গ্রন্থ থেকে নেয়া। ছড়া কিংবা পদ্য রচনায় আল ফরহাদের হাতটা যে বেশ পক্ত তা এই পদ্যাংশের মাধ্যমে খুব সহজেই অনুমান করা যায়। ব্যক্তিগতভাবে এই তরুণ লেখকের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০০৮ সাল থেকে। একজন স্নেহভাজন ছোটোভাই হিসেবে তাঁর সঙ্গে চলাফেরা ও গালগল্পের সুযোগ হয়েছে বহুবার কিন্তু তার মধ্যে যে এত চৎকার কাব্যপ্রতিভা বিদ্যমান সেটা জানতে পারিনি তখনও। জানার সুযোগও হতো না যদি না ফেসবুক নামক একটি অনলাইন মাধ্যমে আমাদের বন্ধুত্ব তৈরি হতো।

সিলেটে জালালাবাদ ইউনিভার্সিটি কলেজের ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া টিনেজার আল ফরহাদ যখন পড়াশোনা করতে ঢাকায় অবস্থান করেন তখন থেকেই মূলত আমরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সময়ের ব্যবধানে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে লন্ডন চলে গেলেও আমার পক্ষে সেটা জানার কোনো সুযোগ ছিল না। ফেসবুকের কল্যাণে হঠাৎ একদিন বন্ধুত্বের অনুরোধ পেলাম। পরিচিত প্রিয়মুখটির অনুরোধে সাড়া দিয়ে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবার পর লক্ষ্য করলাম সেও ছড়া লিখে। ছড়াগুলো ফেসবুকে পোস্ট করার পর অনেক লাইক-কমেন্টও পাচ্ছে। একেবারে নবীন লেখক হলে যা হয় তার ক্ষেত্রে এমনটা দেখা গেল না। লেখার বিষয়বস্তু নির্ধারণ এবং ছন্দ, মাত্রা ইত্যাদি পর্যালোচনা করে মনে হলো সে একজন কাব্যকারই, আমার পরিচিত আল ফরহাদ নয়। কারণ আমি যে আল ফরহাদকে চিনি সে তো কবিতা বা ছড়া লিখতো না।

একদিন একটি ছড়াপোস্টের কমেন্টেই লিখলাম, তুমি আবার লেখালেখি কবে থেকে শুরু করলে? জবাবে সে জানাল, লন্ডন গিয়ে সক্রিয় হয়েছে লেখালেখিতে। কথার ধরন দেখে বুঝতে পারলাম লেখালেখি নামক রোগটি তার মধ্যে আগে থেকেই ছিল। কিন্তু নিভৃতচারী হওয়ায় জনসম্মুখে আসেনি। ছড়াসাহিত্য নিয়ে কাজ করছি বিধায় সে তার ছড়াপোস্টগুলোতে প্রায়ই আমাকে ট্যাগ বা মেনশন করে আমার পরামর্শ চাইতো। এভাবে ধীরে ধীরে ভার্চুয়াল জগতে একটি সম্পর্ক স্থাপিত হয় নতুন করে আল ফরহাদের সঙ্গে। এ সম্পর্কের সূত্র শুধুই সাহিত্য, কেবলমাত্র ছড়াপদ্য।

অনলাইনে বিচরণকালেই কথাপ্রসঙ্গে আল ফরহাদকে একটি বইপ্রকাশের ব্যাপারে পরামর্শ দিলাম। বইপ্রকাশ করার মতো মানসম্পন্ন লেখা সে তৈরি করতে পারছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করল। বললাম, এটা সময়ই বলে দেবে। নিজের লেখাগুলো সংরক্ষণের জন্য, আলোচনায় আনার জন্য বইপ্রকাশ করা জরুরি। এভাবেই আলোচনার এক ফাঁকে আমি এই গ্রন্থটির প্রকাশক হয়ে গেলাম। পৃথিবীতে জন্ম নিল নতুন একটি গ্রন্থ, তরুণ কবি আল ফরহাদের কাগুজে সন্তান- ছন্দে গাঁথা মনের খাতা।

পাপড়ি প্রকাশ থেকে প্রকাশিত ছন্দে গাঁথা মনের খাতা তিন ফর্মার স্ট্যান্ডার্ড বুকসাইজ গ্রন্থটিতে মোট ৪০টি ছড়াপদ্য স্থান পেয়েছে যার অনেকগুলোতেই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষণীয় দিক। কয়েকটি পদ্যে স্মৃতিচারণ করা হয়েছে। দেশাত্মবোধ, ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে বিভিন্ন ছড়া-কবিতায়। বইয়ের একদম প্রথম লেখাটি নিজের বাবাকে নিয়ে। বাবার প্রতি ভালোবাসার বর্ণনা দিয়ে তিনি আল্লাহর কাছে জান্নাতের বাগান প্রার্থনা করেছেন এভাবে-
ছন্দতালে বলছি আমি কাব্য ছড়া বা গান
আল্লাহ তুমি দাও বাবাকে জান্নাতের এক বাগান।
(আমার প্রিয় বাবা।। পৃ. ৯)

অনুরূপভাবে মাকে নিয়েই তিনি সাজিয়েছেন তার দ্বিতীয় কবিতা ‘স্মৃতির পাতায় মা’ শিরোনামে। মায়ের জন্যেও রয়েছে প্রার্থনা-
দোয়া করি মাগো তুমি, দীর্ঘজীবী হও
বটবৃক্ষের ছায়া দিয়ে, আমার পাশে রও।
(স্মৃতির পাতায় মা।। পৃ.১০)

আল ফরহাদ মনের কথাগুলোই তার মনের খাতায় সাজিয়েছেন ছন্দের তালে তালে। পাঠকমহলে জানার আগ্রহ কী তার মনের চাওয়া-
মনের কথা ছন্দে গেঁথে
তৈরি করে ইচ্ছেমতো
ছন্দতালে গড়তে আমার
লাগে অনেক ভালো
স্বপ্ন আমার মনের মাঝে
ন্যায়ের পথে কলম হাতে
প্রতিবাদের কথা বলে
দূর করি সব কালো।
(মনের চাওয়া।। পৃ.১৩)

আমরা যা করি যা বলি তার সাক্ষী আমরা নিজেরাই। আমাদের দৈহিক অঙ্গগুলোই একদিন কাঠগড়ায় দাঁড়াবে সাক্ষী হয়ে।
গোপনে যে পাপ করে যাই দেখছে না তা কেহ?
আল্লাহ নিজে দেখেন এবং দেখে নিজের দেহ!
রোজ হাশরে বিচার দিনে হিসেব যখন হবে
অঙ্গ নিজের সাক্ষী দেবে জানেন তো ভাই সবে?
(সাক্ষী হবে দেহ ।। পৃ.১৬)
রক্তে কেনা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আমরা সবসময়ই রক্ত দিতে প্রস্তুত। এই দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। তবুও স্বাধীনদেশে কেন এখনও রক্ত ঝরে-
সবুজঘেরা বাংলা তোমার, হাসি যেন চাঁদে
ফেলানীদের লাশ দেখে যে মনটা আমার কাঁদে
রক্তে কেনা স্বাধীনদেশে রক্ত কেন ঝরে
বুলেট-গুলি বোমায় কেন আজও মানুষ মরে?
(স্বাধীন দেশ।। পৃ.১৯)

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রধান কবি আল মাহমুদ বলেছেন- ‘আমি না হয় পাখিই হবো, পাখির মতো বন্য’। আমাদের আল ফরহাদ নিজের মনকেই পাখি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার আকুতি-
গাছের ডালে বসতে দিলাম মনপাখি আজ তোরে
সবুজ পাতায় লিখতে থাকিস
পরোপকার শিখতে থাকিস
নতুন কুঁড়ির মতো হয়ে আয় না ফিরে ঘরে।

ভোরের আলোয় জাগতে দিলাম মনপাখি আজ তোরে
অতীতকে তুই ভুলতে থাকিস
নতুনের দ্বার খুলতে থাকিস
সত্যপথের পথিক হয়ে আয় না ফিরে ঘরে।
(আকুতি ।। পৃ.৪৭)

সত্যপথের পথিক হয়ে ঘরে ফিরতে আগ্রহী আল ফরহাদ। আমরা তাঁর গ্রন্থ- ছন্দে গাঁথা মনের খাতা পাঠ করে তাঁকে একজন সত্যপথের পথিক হিসেবেই জানতে পারলাম। এখন কেবল ঘরে ফেরার অপেক্ষা। ঘর মানে, প্রবাসজীবনের বিপরীতে আমাদের দেশ, নিজের দেশে। সময়ের পরিক্রমায় আল ফরহাদ মা, মাটির টানে স্বদেশে থাকবেন নাকি ইউরোপের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে সেখানেই বসবাস করবেন সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে ইউরোপে বসে বসেও তিনি যে বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করছেন, বাংলাসাহিত্যের চর্চা করছেন এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। আমরা তাঁর ছন্দে গাঁথা মনের খাতা গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করছি।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ

© All rights reserved © 2016 Paprhi it & Media Corporation
Developed By Paprhihost.com
ThemesBazar-Jowfhowo