৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ দুপুর ২:৪১

টিকটিকি ঠিকঠিক : ছড়ার ভুবনে এক সরস আহবান

অনন্ত নিগার
  • আপডেট বুধবার, মার্চ ৩১, ২০২১,

সম্প্রতি দর্পণ থেকে প্রকাশ হলো কবি, ছড়াকার ও গল্পকার সুফিয়ান আহমদ চৌধুরীর ‘টিকটিকি ঠিকঠিক’ নামক ছড়ার বই (ফেব্রুয়ারি, ২০২১)। তিন ফর্মার বই। বইটির গায়ের মূল্য ১৮০ টাকা। ছড়া আছে মোট ৪০টি।
শিশুতোষ এ বইটির চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন মোমিন উদ্দীন খালেদ। ‘টিকটিকি ঠিকঠিক’ শিরোনামের ছড়াটি পড়ার পর আমার মনে পড়ে গেল মানিক বন্দোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘টিকটিকি’-এর কথা, যেখানে গল্পের মূলচরিত্র জ্যোতিষার্ণবের স্ত্রী মরার পর থেকে বিশ্বাস করে যে, কোনও কথা বলার পরে টিকটিকি ‘টিকটিক’ শব্দ করলেই তা সত্যি হয়ে যাবে। আসলে এটা স্রেফ গল্প-উপন্যাসে নয়; বরং আমাদের সমাজেরই একটা বাস্তব চিত্র, যেখানে অনেক লোকই এ ধরনের একটি কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন। শৈশবে যেমনটা আমি বিশ্বাস করতাম। যাই হোক। বইটির নামটি তাই আমার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। এরকম শৈশবস্মৃতি জাগানিয়া শিশুতোষ নামকরণই তো ছড়া সাহিত্যের কচি পাঠকদের জন্য আমরা প্রত্যাশা করি।
বইয়ের ফ্ল্যাপের সামনের অংশে লেখক সম্পর্কে উল্লেখিত হয়েছে, ‘সুফিয়ান আহমদ চৌধুরী তার লেখার দূরদর্শী চিন্তা-চেতনা ও আদর্শ বাঙালির মনমানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।’ উল্লেখ্য, নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখক সুফিয়ান আহমদ চৌধুরী একাধারে কবি, ছড়াকার, গল্পকার, সংগঠক এবং আইনজীবী। বহু গ্রন্থপ্রণেতা এই লেখক ছড়া পরিষদ সিলেট; সিলেট সাহিত্য পরিষদ ও স্বদেশ ফোরাম, নিউইয়র্ক’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তিনি জড়িত রয়েছেন দেশ-বিদেশের সাহিত্য-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন সংগঠনের সাথে; কুড়িয়েছেন অনেক সুনাম।
আসি বই প্রসঙ্গে। ‘টিকটিকি ঠিকঠিক’ বইটি মূলত শিশু-কিশোরদের জন্য সুপাঠ্য ও উপভোগ্য কিছু ছড়া নিয়ে সুসজ্জিত। শৈশব-কৈশোরের নানা বিষয় উপাদান নিয়ে রচিত চল্লিশটি ছড়ার সমারোহে কচি পাঠকেরা ছড়ার ছন্দে যেমন আনন্দিত হবে, পাশাপাশি তাদের ভাবনাচিন্তার সমান্তরাল সকল উপাদান থাকায় বইটি পাঠ করে তাদের ভেতরের রসবোধও জেগে ওঠবে। বইটির সূচিতে চোখ বুলালেই পাঠকরা বইটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা পাবেন-
টিকটিকি ঠিকঠিক, মামার বাড়ি, বৃষ্টি দিনে, আঁকছে খুকু, শোকের মিছিল, তেলাপোকা, অঙ্কের ছাত্র, গোপালভাঁড়ের ছড়া, মায়ের আঁকি ছবি, এই হেমন্তে, ঝিকঝিক, কুটুম এলো, টোকাই, কিশোর ছেলে, খোকার ছবি, বিজয় এলে, ঘাসফড়িং, আকাশছোঁয়া স্বপ্ন, ছুটির দিনে, নতুন দিন নতুন স্বপ্ন, সোনার বরণ গাঁয়, জীবন ছন্দে, আমার দেশে, আমার ছড়া, চাঁদ রাঙা চাঁদমণি, মিষ্টি মেয়ে, ঈদ, শীত সকালে, স্বপ্ন, ঝুমুর ঝুমুর বৃষ্টি, ফুলের হাসি, জীবন ছবি আঁকে, স্বপ্ন আঁকা, রঙিন পাখি, মেঘ দিন মেঘে, কিশোরবেলা, শরতের রাঙা দিন, বৈশাখীর ঝড়ে, থেমেছে ব্যস্ত জীবন, সিলেট আমার।
ছড়ার ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল ছড়া বলার ধরন। যোগ্য কবির বেলায় সেই বলার ধরনটির প্রভাব হয় আরও ইতিবাচক ও আনন্দসঞ্চারি। ১৯৭৩ সাল থেকে যার ছড়া, কবিতা, গল্প লেখার মধ্যদিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল, এই সুদীর্ঘ সময় পরে তাঁর ছড়া, কবিতা বর্তমানে কতটা প্রাণবন্ত ও সরস হয়ে উঠবে তা সহজেই অনুমেয়।
যেহেতু ছড়ার বই, সুতরাং কবি কেমন ছড়া লিখেছেন তা জানার জন্য দুয়েকটা ছড়া উপস্থাপন করা উচিত।
তাই কথা না বাড়িয়ে বরং বই থেকেই কিছু পঙক্তি দিয়ে উদাহরণ দেওয়া যাক
‘টিকটিকি ঠিকঠিক’ শিরোনামের ছড়ায় এসেছে- ‘টিকটিকি অই দেয়ালেতে/ করে কী যে ঠিকঠিক/ খুকুমণি লাল জামা গায়ে/ জামা করে চিকচিক।’

বৃষ্টির দিনে শিশু-কিশোরদেরই মন আনন্দে নেচে ওঠে। তবে শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক হলেও গ্রামের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে কৃষকগোষ্ঠীর জন্য তা দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ‘ঝুমুর ঝুমুর বৃষ্টি’ ছড়ায় কবি বুঝি সেই চিত্রটাই ফুটিয়ে তুলেছেন- ‘বৃষ্টির জল টাপুর টুপুর/ মাথায় ছাতা চাষি/ খেতের ফসল বৃষ্টির জলে/ বান যে সর্বনাশি।’
সুজলা-সুফলা এই সবুজ দেশের গ্রামবাংলার চিরপরিচিত দৃশ্য হচ্ছে মাঠে থাকা রাখালদের মাঠে বিচরণ করা কিংবা নদীর ঘাটে নারীদের কলসি কাঁখে হেঁটে চলা। ‘আমার দেশে’ ছড়ায় কবি তাই লিখেছেন- ‘আমার দেশে রাখাল মাঠে/ বাজায় বাঁশি সুখে/ সরল বধূ কলসি কাঁখে/ লাজুক হাসি মুখে।’
ছড়াকার সুফিয়ান আহমদ চৌধুরী অতীত স্মৃতিচারণ করেছেন ‘জীবন ছন্দে’ ছড়ায় এভাবে- ছড়ার মেলা ছড়ার হাটে/ মনটা মাতায় রোজ/ ছড়া পরিষদ নিয়ে হতো/ ছড়ার সাথি খোঁজ।
সাধারণত ঈদের আনন্দ মানুষের শৈশবেই থাকে বেশি। কনকনে শীতের সকালে ঘুম থেকে ওঠে গোসল করে নতুন জামা পরা, ঈদগাহে গিয়ে নামায পড়া, কুলাকুলি করা- এই সুখের স্মৃতিগুলো প্রাপ্তবয়স্ক সব মানুষের মনেই হাতছানি দেয়। ঈদ নিয়ে লেখা ছড়ায় কবি লিখেছেন- ‘ইলিক ঝিলিক সবুজ দেশে/ সোনার বরণ ঈদ/ খোকন সোনার রঙিন মন/ নেইতো চোখে নিদ।’
প্রবাসে থাকা সকল ব্যক্তিই মাতৃভূমির প্রতি দুর্বার টান অনুভব করেন। বাদ পড়েননি আমাদের কবিও। ছন্দের তালে তালে সেই অনুভূতি তিনি ব্যক্ত করেছেন ‘আমার ছড়া’ নামক ছড়ায় এভাবে- ‘আমার ছড়া স্বপ্ন আঁকে/ দেশের স্বপ্ন আঁকে/ আমার ছড়া দূর প্রবাসে/ খুঁজছে প্রিয় মাকে।’
স্বদেশপ্রেমের আরেকটি সহজাত অংশ হচ্ছে ভাষাপ্রেম। মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে কবি লিখেছেন- ‘চলছে যখন ভাষার মিছিল/ ছুঁড়লো ওরা গুলি/ শহীদ হলো সালাম-রফিক/ রাখতে মায়ের বুলি।’
সাম্প্রতিক করোনা পরিস্থিতি নিয়েও ‘থেমেছে ব্যস্ত জীবন’ নামক একটি ছড়া তিনি লিখেছেন। তাতে লিখেছেন- ‘করোনার দাপটটা কত/চারদিকে ঘোর/ দরজা এঁটে ঘরের ভেতর/ কবে হবে ভোর?’

বইটির প্রত্যেকটি ছড়াই আনন্দদায়ক। সব ছড়ার কথা তো আর এই ছোট্র পরিসরের আলোচনায় আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাই পাঠকদের প্রতি অনুরোধ রইল বইটি সংগ্রহ করে পড়ার, বিশেষ করে বাসায় কচি পাঠক থাকলে তাদের হাতে বইখানি তুলে দেওয়ার।
বইটির প্রকাশ করেছে দর্পণ প্রকাশ। ছাপার মান ভালো। এজন্য প্রকাশককেও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।
পরিশেষে আশা রাখা যায় যে, ছড়াপ্রেমী প্রত্যেক শিশু-কিশোর বইটি পড়বে এবং ছড়াগুলো পছন্দ করবে।
এ ধরনের ছড়ার বই আরও প্রকাশিত হোক, লেখকের কাছ থেকে আমরা এই প্রত্যাশা করি।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2016 Paprhi it & Media Corporation
Developed By Paprhihost.com
ThemesBazar-Jowfhowo