সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এমন কয়েকটি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যার ফলে পুলিশের ভাবমূর্তি মারাত্মক সংকটে পড়েছে। এর মধ্যে দুটো ঘটনা উল্লেখযোগ্য। একটি টেকনাফে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা হত্যা ও ওসি প্রদীপের দুর্নীতিকাণ্ড এবং দ্বিতীয়টি সিলেট নগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ১০ হাজার টাকা চাঁদার জন্য রায়হান আহমদ নামক এক নিরপরাধ যুবককে পিটিয়ে হত্যা।
এ দুটো ঘটনা পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা তলানিতে ঠেলে দিয়েছে। এখন পুলিশ ভালো কাজ করলেও ভালো বলা যায় না। যিনি ভালো বলবেন তাকে মানুষ পুলিশের দালাল বলে গালি দেবে। এটা বাংলাদেশ পুলিশবাহিনীর জন্য বিব্রতকর এবং সৎ পুলিশ অফিসারদের জন্য খুবই পীড়াদায়ক।
বাংলাদেশে অনেক সৎ পুলিশ অফিসার আছেন, যারা অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন করেন। তাদের বাসাবাড়িতে গেলে জীবনযাত্রা দেখে সেটি উপলব্ধি করা যায়। যেহেতু উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের পুলিশের বেতন-ভাতা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নয়, তাই একজন পুলিশ অফিসারকে সততার সঙ্গে জীবনযাপন করতে হলে তাকে আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে চলতে হয়। তাকে পরিবারের আবদার মেটাতে হিমশিম খেতে হয়।
ছেলেমেয়েদের ভালো স্কুলে লেখাপড়া করানো সম্ভব হয় না। স্ত্রীর চাহিদামতো বাজার-সদাই করতে পারেন না।
একজন সৎ পুলিশ কর্মকর্তা যদি কোনো থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হয়ে থাকেন, তাহলে তার সামনে অসৎ উপায়ে অর্থ কামাইয়ের বিভিন্ন পথ খোলা থাকায় সেই পথ থেকে নিজেকে বিরত রেখে সততার সঙ্গে জীবনযাপন করা আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে। পুলিশ মানেই মিথ্যা মামলা রেখে দু’পক্ষের কাছ থেকে ঘুষ আদায়-এ ধরনের একটি নেতিবাচক ধারণা সাধারণ মানুষের মনে বীজ বুনে আছে।
পুলিশের ওপর ঢালাওভাবে দুর্নীতির যে তকমা, তা একজন সৎ পুলিশ অফিসারের জন্য বড়ই পীড়াদায়ক। কারণ, তিনি সংগ্রাম করে সততার মধ্য দিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন, অথচ অনেকেই তাকে অসৎ হিসেবে মূল্যায়ন করছে।
পুলিশের চাকরি এমন যে, এখানে সততার সঙ্গে চাকরি করা একটি বড় পরীক্ষা। এমন অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে চিনি যারা শিক্ষাজীবনে সৎ ছিলেন। পুলিশে চাকরির প্রথম জীবনেও সততার সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু এক সময় দেখা গেল দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। কারণ, পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাকে দুর্নীতিবাজ হতে বাধ্য করেছে।
একজন থানার ওসির অনেক ক্ষমতা। তিনি একটি শহর বা উপজেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সর্বোচ্চ কর্মকর্তা। তার কাছে মানুষ প্রতিদিন বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আসে। ওসি সাহেব কিছু বলার আগেই তার জন্য টাকার বান্ডিল অপেক্ষা করে। বাসায় পৌঁছে যায় তরতাজা বড় মাছ, ঘরের দরজায় চকচকে পর্দা, দামি ফার্নিচার। নিজে কিছু না চাইলেও উপঢৌকন দেদার আসতে থাকে।
আর এসব কারণে একজন পুলিশ কর্মকর্তার পক্ষে নিজের সততা বেশিদিন ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। একদিকে তার পারিবারিক ও নৈতিক শিক্ষা তাকে লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে রাখতে চায়, অন্যদিকে পরিবারে আর্থিক টানাপোড়েন এবং অন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের টাকা বানানোর প্রতিযোগিতা ও বিলাসবহুল জীবনযাপন দেখে তিনি নিজেকে বেশিদিন ধরে রাখতে পারেন না।
এভাবেই এক সময় তিনিও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। আর একবার যখন দুর্নীতি শুরু করেন, তখন আপাদমস্তক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েন। যেহেতু ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের একটি অংশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দেয়ার অলিখিত নিয়ম রয়েছে, তাই সমাজের কাউকে পুলিশের পরোয়া করার প্রয়োজন পড়ে না। বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়িতে নিরপরাধ মানুষকে ধরে এনে মিথ্যা মামলায় জড়ানোর ভয় দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
তাই বাংলাদেশে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মতো একটি নিরাপদ জায়গা তৈরি করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় পুলিশের অভিযোগ তদন্তের জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা রয়েছে। ব্রিটেনে এক সময় ছিল ইনডিপেনডেন্ট পুলিশ কমপ্লেইন্টস কমিশন। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সংস্থাটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ইনডিপেনডেন্ট অফিস ফর পুলিশ কনডাক্ট।
এ সংস্থায় পুলিশের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলে অভিযোগকারীর পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রেখে অভিযোগটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা হয়। পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। তাই পুলিশ সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময় বুঝেশুনে কথা বলে। পুলিশ জানে তারা আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
অনিয়ম করলে মানুষ অভিযোগ করবে। অভিযোগ গুরুতর হলে চাকরি হারাতে হবে। শাস্তিও হতে পারে। তাই পুলিশ সাধারণ মানুষের সঙ্গে আইনের মধ্যেই থাকে।
বাংলাদেশে ব্রিটেনের মতো ইনডিপেনডেন্ট ‘অফিস ফর পুলিশ কনডাক্ট’ নামক স্বাধীন তদন্ত সংস্থা নেই। তবে পুলিশের লোকজনের সমন্বয়ে আছে পুলিশ ব্যুরো অব ইভেস্টিগেশন। এটিও ইনডিপেনডেন্ট বডি। তবে পুলিশের লোকজন দিয়ে এ বডিটি চালানোর কারণে মানুষের আস্থা কম। তাই প্রয়োজন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ আলাদা একটি স্বাধীন তদন্ত সংস্থার। প্রয়োজনে সেনাবাহিনী থেকে চৌকস কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি সেল গঠন করা যেতে পারে, যেখানে বিচার বিভাগের লোকজনও থাকবেন।
এ ছাড়া দেশের প্রতিটি থানায় একটি করে অভিযোগ বাক্স স্থাপন করা যেতে পারে। এ বাক্সগুলোর নিয়ন্ত্রণ থাকবে পুলিশের নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থার হাতে। প্রতিমাসে সংস্থার লোকজন নিজে গিয়ে বাক্সটি খুলে অভিযোগগুলো নিয়ে আসবেন। সেখানে মানুষ নিজের নাম-ঠিকানা গোপন রেখেও যাতে অভিযোগ করতে পারে, সেই সুযোগও রাখতে হবে।
আর নাম-ঠিকানা থাকলে সেটি যাতে সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয় তারও শতভাগ নিশ্চয়তা থাকতে হবে, যাতে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পর ওই অভিযোগকারীর জীবন ঝুঁকিতে না পড়ে। কারণ, আমরা এ ধরনের অনেক ঘটনা অহরহ দেখতে পাই।
ওসির অত্যাচার-নির্যাতন থেকে মুক্তি চেয়ে পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করার পর সংশ্লিষ্ট থানার ওসি ওই ব্যক্তিকে থানায় ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন করেছেন, তার চোখে মরিচের গুঁড়া দিয়েছেন কিংবা প্লায়ার্স দিয়ে নখ তুলে নিয়েছেন। তাই অভিযোগকারীর নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এ উদ্যোগটি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা গেলে থানার পুলিশ অফিসাররা সতর্ক থাকবেন। কারণ, অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রমোশন আটকে যেতে পারে। অপরাধ বিবেচনায় চাকরিও হারাতে হতে পারে। তবে এটাকে শুধু দানবাক্সের মতো নামকাওয়াস্তে অভিযোগ বাক্স হিসেবে বসিয়ে রাখলে চলবে না।
প্রকৃত অর্থেই একটি কার্যকর অভিযোগ সেন্টার হতে হবে। প্রতিমাসে কটি অভিযোগ জমা পড়ল, কী ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেল, কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হল-এসব নিয়মিত মিডিয়ায় তুলে ধরতে হবে। তাহলে পুলিশ অফিসাররা সতর্ক থাকবেন এবং দুর্নীতির মাত্রা কিছুটা কমতে পারে।
আরও একটি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। পুলিশের গায়ে বডি ক্যামেরা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। ব্রিটেনে যখন পুলিশ কর্মকর্তারা কোনো অভিযানে যান, তখন তাদের ইউনিফর্মের সঙ্গে সংযুক্ত বডি ক্যামেরা অন করে রাখা বাধ্যতামূলক। ফলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোনো অন্যায় করলে সেটি রেকর্ড হয়ে থাকে। পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে তা প্রমাণের জন্য বডি ক্যামেরা থেকেই এভিডেন্স পাওয়া যায়।
সর্বোপরি প্রতিটি থানা এবং পুলিশ ফাঁড়ি ২৪ ঘণ্টা সিসিটিভি মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা জরুরি। এখন সম্ভবত অনেক থানায়ই সিসিটিভি আছে। তবে সিসিটিভিগুলো কি সার্বক্ষণিক সক্রিয় থাকে? হাজতখানাসহ যেসব জায়গায় আসামি রাখা হয় সেসব স্থানে কি সিসিটিভি আছে, থাকলে কি তা কাজ করে? এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
আর সিসিটিভিগুলোর সংযোগ পুলিশ সুপার, পুলিশ কমিশনার, ডিআইজির কার্যালয় পর্যন্ত থাকা প্রয়োজন, যাতে বড়কর্তারা অফিসে বসেই থানা ও ফাঁড়িগুলো মনিটর করতে পারেন এবং অপরাধ সংঘটিত হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা সিসিটিভির ফুটেজ নষ্ট করতে না পারেন। বাংলাদেশ পুলিশে এ সংস্কারগুলো এখন সময়ের দাবি।
তাইসির মাহমুদ : সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ, লন্ডন