১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ বিকাল ৫:৫৩

বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও কিছু কথা

কামরুল আলম
  • আপডেট রবিবার, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২১,
বিভিন্ন দিবসের মধ্যে বিশ্বভালোবাসা দিবস একটি। এ দিবসটিকে কেন্দ্র করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে নানা উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখে এ দিবসটি পালিত হয়। বাংলায় ভালোবাসাদিবস বলা হলেও ইংরেজিতে এটি ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ নামে পরিচিত এবং আমাদের দেশেও ভালোবাসাদিবস বলার চেয়ে ভ্যালেন্টাইন ডে বলার প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। মজার বিষয় হলো ভালোবাসাদিবসের সরল ইংরেজি অনুবাদ ‘লাভ ডে’ হওয়ার কথা থাকলেও কেউ এটাকে লাভ ডে না বলার কারণটাও অনেকের কাছেই অজানা। অথচ উৎসাহ-উদ্দীপনা আর বুকভরা ভালোবাসানিয়ে দিবসটি আমাদের তরুণ-তরুণীরা উদযাপন করছে। তাদের অধিকাংশ জানেই না আসলে এ দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য কী? এমনকি কবে কোথায় কেন এ দিবস পালন শুরু হয়েছিল তাও অধিকাংশেরই অজানা। আর কেউ বা জেনে থাকলেও মূল বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করার মতো বাস্তব অবস্থার মুখোমুখি হতে পারে না। আসুন জেনে নেই ভ্যালেন্টাইন ডে’র চমকপ্রদ কিছু কাহিনী।
২৭০ ঈসায়ি সনের কথা। বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলে যুদ্ধের প্রতি পুরুষদের অনীহা সৃষ্টি হয় বলে মনে করতেন তৎকালীন রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস। তাই তিনি নারী-পুরুষের বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তার নিষেধাজ্ঞার পর নারী-পুরুষেরা আর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারতো না প্রকাশ্যে। তবে গোপনে অনেকে বিয়ের কাজটি সেরে ফেলতো। তখন খৃষ্টান গীর্জার পুরোহিত ‘ভ্যালেন্টাইন’ সম্রাটের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে গোপনে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে দিতেন। গোপনীয়তা আর কতদিন চলে? একসময় বেচারা ভ্যালেন্টাইন ধরা পড়ে যান। তাঁকে ধরে সম্রাটের দরবারে হাজির করা হলো। মিস্টার ভ্যাল্টোইন সম্রাটকে বললেন, আমি খৃষ্টধর্মে বিশ্বাসী। ধর্মের বিধান অনুযায়ী নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা নিষেধ। একমাত্র বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেই তারা মেলামেশা করতে পারবেন। তাই আমি একজন ধার্মিক হয়ে কাউকে বিবাহবন্ধনে নিষেধ করতে পারি না।
সম্রাট’র কাছে দেওয়া জবানবন্দি অনুযায়ী ভ্যালেন্টাইন একজন মারাত্মক অপরাধী হিসেবে গণ্য হলেন। একে তো সম্রাটের হুকুম অমান্য করেছেন তাও আবার এরপক্ষে যুক্তি দাঁড় করিয়ে তিনি ধর্মের পক্ষে কথা বলছেন! এটা মেনে নেওয়া তো সম্ভব না। ভ্যালেন্টাইনকে শাস্তি পেতে হবে। কঠিন শাস্তি। সম্রাট তাই শাস্তিস্বরূপ ভ্যালেন্টাইনকে কারাদন্ডে দন্ডিত করেন। কারাগারে যাওয়ার পর সম্রাট ভ্যালেন্টাইনকে খৃষ্টধর্ম ত্যাগ করে প্রাচীন রোমান পৌত্তলিক ধর্মে ফিরে আসার প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন কেবল এটাই ভ্যালেন্টাইনের মুক্তির একমাত্র পথ। যদি ভ্যালেন্টাইন সম্রাটের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান তাহলে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হবে। ভ্যালেন্টাইন সম্রাটের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে স্বীয় খৃষ্টধর্মের প্রতি অনুগত রইলেন। ফলে সম্রাট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করেন। ২৭০ ঈসায়ি সনের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
এদিকে ভ্যালেন্টাইন’র আরেকটি পরিচয় ছিল। তিনি একজন চিকিৎসকও ছিলেন। কারাগারে থাকাকালীন সময়ে জেলারের অন্ধ মেয়েকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলেছিলেন তিনি। মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ার পূর্বে ভ্যালেন্টাইন জেলারের মেয়ের কাছে একটি চিঠি লিখেন। চিঠির নিচে লেখা ছিল ‘লাভ ফর ইয়োর ভ্যালেন্টাইন’।
পরবর্তীতে রোমান সাম্রাজ্যে খৃষ্টধর্মের প্রাধান্য সৃষ্টি হলে ভ্যালেন্টাইনকে ‘সেইন্ট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ৩৫০ ঈসায়ি সনে যে স্থানে ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল সেখানে তাঁর স্মরণে একটি গীর্জা নির্মাণ করা হয়। এরপর ৪৯৬ ঈসায়ি সনে খৃষ্টান সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু পোপ গ্লসিয়াস ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সেইন্ট ভ্যাল্টোইন ডে’ হিসেবে ঘোষণা করেন।
জেলারের মেয়েকে ভালোবাসার কারণে কিন্তু খৃষ্টান সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু এই দিবসটির প্রচলন করেননি। কারণ খৃষ্টধর্মে পুরোহিতের জন্য বিয়ে বৈধ নয়। সুতরাং জেলারের মেয়ের প্রেমে পড়ে যাওয়াটা ভ্যালেন্টাইনের জন্য ‘অনৈতিক কাজ’ হিসেবে গণ্য হয়। তাছাড়া জেলারের মেয়ের প্রেমে পড়ে যাওয়াতে ভ্যালেন্টাইনকে জেলে যেতে হয়নি বরং জেলে গিয়েছিলেন তিনি ধর্মের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্যে। জেলারের মেয়ের চিকিৎসা করে তাকে সুস্থ করে তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে আদৌ ভালোবেসেছিলেন কি না তা পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। যদি ভালোবেসেও থাকেন সে ভালোবাসার দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল সেটাও একটা বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। যে পুরোহিত নিজে ধর্মের প্রতি অনুগত থেকে মৃত্যুদন্ডকে বরণ করে নিলেন তাঁর পক্ষে কি এমন অনৈতিক একটি কাজে জড়িয়ে পড়া সম্ভব?
সুতরাং এ বিষয়টি স্পষ্ট যে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ ঘোষিত হয়েছিল পুরোহিত ভ্যালেন্টাইন’র মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার দিনটিকে স্মরণে রাখার জন্য, কাউকে ভালোবাসার জন্যে নয়। আর ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল খৃষ্টধর্মের প্রতি অনুগত থাকায়, কাউকে ভালোবাসার অপরাধে নয়।
আজকাল মানুষ না বুঝেই ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভালোবাসাদিবস হিসেবে পালন করছে। এ দিবসে অনেকেই বিয়ের তারিখ পর্যন্ত ঠিক করেন। আর বিভিন্ন উদ্যানে এ দিবসে পুটুসপাটুস প্রেমের যে কার্যক্রম করে থাকেন তার বিস্তারিত বর্ণনা করা তো প্রায় অসম্ভবই। এছাড়া ঈদকার্ড বা বার্থডে কার্ড’র ন্যায় ভালোবাসাদিবসের কার্ডও ছাপানো হয়। মনের মানুষের কাছে পাঠানো হয় নানা দামি দামি গিফট আইটেম।
আমরা নিজেরাই আমাদেরকে ‘হুজুগে বাঙালি’ বলি। আলোচ্য ভালোবাসাদিবস বা ভ্যালেন্টাইন ডে’র কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে এ কথাটি অস্বীকার করার আর কোনো উপায়ই থাকে না বোধ করি।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2016 Paprhi it & Media Corporation
Developed By Paprhihost.com
ThemesBazar-Jowfhowo