বেহুলা লক্ষিন্দরের পৌরাণিক কাহিনী থেকে জানা যায় যে, চাঁদ সওদাগর বাণিজ্য করার জন্য লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে চম্পক নগর থেকে উজানি নগর যেতেন। পন্ডিতগণ মনে করেন প্রায় চার হাজার বছর আগে হাওরাঞ্চলই ছিল লোহিত সাগরের বিশাল জলরাশি। দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে আছড়িয়ে পড়ত লোহিত সাগরের উত্তাল উর্মিমালা।
সাগর মূলত একটি সংস্কৃত শব্দ। এর বিবর্তিত শব্দ সায়র। আর সায়র শব্দ থেকে কালের বিবর্তনে হাওর শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। আবার অনেকেই ফার্সী শব্দ বাহার (যার অর্থ সাগর) এর বিকৃত রূপ বলে মনে করে থাকেন। হাওর মূলত প্রত্যেকটিই এক একটি প্রাকৃতিক হ্রদ। ইহা হচ্ছে মূলতঃ এক ধরনের বিস্তৃত জলমগ্ন কিংবা জলশূন্য ভূমি কিংবা নিম্ন জলাভূমি। প্রতিটি হাওরই সাধারণতঃ গভীর নদী বা খালের পাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। হাওরগুলো গভীরতায় খুব বেশি নয়। বর্ষাকালে হাওরগুলোকে সাগরের মত মনে হয়। তখন যেদিকেই চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। এই সময় জনপদ বা গ্রামগুলোকে সাগরের বুকে ছোট ছোট দ্বীপের মত ভাসতে দেখা যায়। শীত মৌসুমে হাওরে পানি থাকে না। তখন থাকে শুধু বিশাল আকৃতির ফসলের মাঠ। বড় বড় হাওরে সূর্য উঠে ও অস্ত যায়। শুকনা মৌসুমে যখন সূর্য উদিত হয় তখন দেখা যায় মাট ভেদ করে অগ্নিদগ্ধ সূর্যটি তার আলোর পসরা সাজিয়ে মহাকাশে আগমন করছে। এই অপরূপ দৃশ্য নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
আমাদের বাংলাদেশ মূলত একটি কৃষি প্রধান দেশ। কৃষিই হচ্ছে এই দেশের মানুষের প্রধান পেশা এবং অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। কথায় বলে ভাতে-মাছে বাঙালি। অর্থাৎ ভাতই হচ্ছে আমাদের প্রধান খাদ্য। আর এই প্রধান খাদ্য আমরা পেয়ে থাকি ধান থেকে। বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলে সাধারণত এই ধান বেশি করে উৎপাদিত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে সাতটি জেলা নিয়ে এই হাওরাঞ্চল গঠিত। এই সাতটি জেলা হচ্ছে সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এই অঞ্চলটি এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ হাওরাঞ্চল নামে পরিচিত। বাংলাদেশের এই হাওরাঞ্চলে ছোট বড় মিলে চার শতাধিক হাওর রয়েছে। এই হাওরাঞ্চলের আয়তন ৮ লাখ ৫৮ হাজার, ৪৬০ হেক্টর। হাওরের মাটি পলি দ্বারা গঠিত বলে খুবই উর্বর এবং এই অঞ্চলে বছরে প্রায় ৩ লাখ টন খাদ্য উৎপাদিত হয়। যা দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই এই অঞ্চলটি বাংলাদেশের খাদ্য গুদাম বা বুরো ধানের শস্য ভান্ডার হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এই হাওরাঞ্চলের সাতটি জেলার মধ্যে ৪টি জেলাই রয়েছে সিলেট বিভাগে। এই ৪ জেলা নিয়ে সিলেট বিভাগের হাওরাঞ্চলে ছোট বড় মিলে ৪২৪টি হাওর রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে জানা গেছে এই মৌসুমে সিলেট বিভাগের চার জেলায় ৪ লক্ষ ৮৫ হাজার ৪৯৫ হেক্টর জমিতে বুরো ধানের আবাদ করা হয়েছে তন্মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলায় সর্বাপেক্ষা বেশি জমিতে আবাদ করা হয়েছে। সূত্রের হিসাব অনুসারে সুনামগঞ্জ জেলায় ২ লক্ষ ২২ হাজার ৬৯৫ হেক্টর, হবিগঞ্জ জেলায় ১ লক্ষ ২২ হাজার ৩ শত হেক্টর, সিলেট জেলায় ৮৩ হাজার ৭ শত হেক্টর এবং মৌলভীবাজার জেলায় ৫৬ হাজার ৮ শত হেক্টর জমিতে এই বৎসর ধান চাষ করা হয়েছে।
কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রত্যাশা করছেন এই বৎসর যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকে এবং কৃষকরা যদি ঠিকমত তাদের ফসল কেটে ঘরে তুলতে পারে তাহলে চার জেলায় মোট ১৯ লক্ষ ৮৫ হাজার ৮৪৬ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হাওরের ‘মা’ বলে খ্যাত সুনামগঞ্জ জেলা থেকে পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সূত্রমতে এই বৎসর সুনামগঞ্জ জেলায় ৯ লক্ষ ১ হাজার ৪৮১ মেট্রিকটন, হবিগঞ্জ জেলায় ৫ লক্ষ ২২ হাজার ১০৯ মেট্রিক টন, সিলেট জেলায় ৩ লক্ষ ৩২ হাজার মেট্রিক টন এবং মৌলভীবাজার জেলায় ২ লক্ষ ২৯ হাজার ৪০৯ মেট্রিক টন চাউল উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সিলেট বিভাগের ৪০টি উপজেলায় ছোট বড় মিলে মোট ৪২৪টি হাওর রয়েছে। এর মধ্যে ১১৬টি বড় এবং ৩০৮টি ছোট হাওর রয়েছে। প্রতি বছরই এই অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়। যা দেশের সার্বিক খাদ্য চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। উল্লেখ্য গত মৌসুমেও এই বিভাগের ৪২৪টি হাওরে মোট ৪ লাখ ৮৩ হাজার ৭০৫ হেক্টর জমিতে ইরি-বুরো আবাদ করে ১৯ লাখ ৩৭ হাজার ৯৭৮ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছিল। মৌসুম শেষে টার্গেট প্রায় পরিপূর্ণ করে এই বিভাগ থেকে ৮ হাজার ৭২০ কোটি টাকার ধান উৎপাদন করা হয়েছিল।
সিলেট বিভাগের হাওরাঞ্চলের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি হাওর রয়েছে সুনামগঞ্জ জেলায়। এই জেলায় ছোট বড় মিলে ১৫৪টি হাওর রয়েছে। সিলেট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধানও উৎপাদিত হয় এই সুনামগঞ্জ জেলায়। তাই সুনামগঞ্জকে হাওরের ‘মা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
হাওর অধ্যুষিত এই সুনামগঞ্জ জেলায় ফসলের মৌসুমে বরাবরই প্রবল বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে এই অঞ্চলে দেখা দেয় অকাল বন্যা। মার্চের দিকে শুরু হওয়া এই অকাল বন্যার কারণে হাওরের বুরো ধান অসময়ে পানিতে ভেসে যায়। ইহা সুনামগঞ্জের জন্য একট অন্যতম প্রাকৃতিক সমস্যা। এই সমস্যাকে উপেক্ষা করে চলার কোন উপায় নাই। তাই বৃহত্তর সিলেটের শষ্য ভান্ডার সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলকে অকাল বন্যাসহ সকল প্রকারে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নানাবিধ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় প্রতি বছরেই। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হাওরের ফসল রক্ষা বাধ নির্মাণ বা বেড়ি বাঁধ তৈরিকরণ। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে সুনামগঞ্জ জেলায় হাওর রক্ষা বাঁধ বা ডুবন্ত বেড়ি বাঁধের পরিমাণ ১ হাজার ৬৮০ কিলোমিটার। এর অধিকাংশ বাঁধই বর্ষাকালে পানির নিচে তলিয়ে যায়। আর এই বাঁধই হল অকাল বন্যার হাত থেকে ফসলকে বাঁচানোর একমাত্র পন্থা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের মাধ্যমে জানা গেছে জেলার ১২টি উপজেলার বিভিন্ন হাওরেরর বুরো ফসল রক্ষা করার জন্য এবার ৭২৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি জেলার ১৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজার সহ ৫৩২ কিলোমিটার বাঁধ এবার নির্মাণ করবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে। এই জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ১১০ কোটি ৮৪ লক্ষ টাকা। এই বেড়ি বাঁধ বা ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার করার জন্য প্রতি বছরই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করা হয়। ২০২০-২০২১ অর্থ বছরেও জেলার ৭৮০টি পিআইসির মাধ্যমে ৬১৩ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার করার জন্য ১২৫ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল।
নীতিমালা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট বছরের বা মৌসুমের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধ নির্মাণ করার কথা রয়েছে। কিন্তু কোন বছরেই এই কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এবং সঠিক নিয়মে ও প্রক্রিয়ায় সম্পাদিত হয় না। ফলে হাওর পাড়ের কৃষকরা উৎকণ্ঠায় ও দুশ্চিন্তায় দিন কাটায়। কর্তৃপক্ষের অবহেলা, গাফিলতি, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির কারণে অনেক বৎসর দেখা যায় যে, সঠিক সময়ে পিআইসি গঠিত হয় না, সময়মত বরাদ্দ ছাড় করা হয় না অথবা যথেষ্ট পরিমাণ বরাদ্দও দেওয়া হয় না। ফলে সঠিক সময়ে কাজ শুরু হয় না এবং শেষও হয় না। তাছাড়াও দেখা যায় যে অনেক সময় সঠিক পরিমাণ উচ্চতা, প্রশস্ততা ও দৈর্ঘ্যও ঠিক থাকে না। ফলে অকাল বন্যা দেখা দিলে বাঁধ উপচিয়ে পানি পড়ে অথবা অতি সামান্য পানির চাপেই বাঁধ ধ্বসে যায় ও ভেঙ্গে যায়। ফলে কোটি কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়ে কৃষকের মাথায় বজ্রাঘাত নেমে আসে।
জেলার বেড়িবাঁধ বা হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে প্রতিবছরই অবহেলা, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম, দুর্নীতি, সঠিক সময়ে কাজ সম্পাদিত না হওয়াসহ নানা প্রকার অভিযোগ উত্থাপিত হয়ে থাকে। এই বৎসরও বিভিন্ন দৈনিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পত্রিকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, কৃষক প্রতিনিধি ও হাওর উন্নয়ন ও প্রতিরক্ষা সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের অভিযোগ ও বক্তব্যের মাধ্যমে জানা যায় যে নীতিমালা অনুসারে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অধিকাংশ কাজই সমাপ্ত হয় নাই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণে আরও ১০ দিন সময় বৃদ্ধি করার পরও সঠিক সময়েও সঠিকভাবে শতভাগ কাজ সমাপ্ত হয় নাই। ফলে স্থানীয় কৃষক সমাজ ও সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন নিবেদন ও স্মারকলিপি প্রদান করতে দেখা গেছে। এই সমস্যা নিয়ে কোন কোন নেতৃবৃন্দ সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে সমস্যা সমূহ তুলে ধরারও চেষ্টা করেছেন। আবার কোথাও কোথাও কৃষককূল একত্রিত হয়ে মানবন্ধনের মাধ্যমে কাজের অনিয়ম, দুর্নীতি ও সময়মত সমাপ্ত না হওয়ার জন্য প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছে। জেলার কৃষক সমাজ আজ খুবই শংকিত ও উৎকণ্ঠিত হয়ে জীবন যাপন করছে। তারা প্রত্যাশা করছে বাকী কাজ সঠিক সময়ে ও সঠিকভাবেই সম্পন্ন হবে। আর তারা হবে শংকা ও উৎকণ্ঠামুক্ত।
সুনামগঞ্জ জেলার হাওর পাড়ের কৃষকদের একটি মাত্র ফসল বুরো ধান। তাই দিয়ে তাদের সারা বছরের খাদ্য সরবরাহ, কাপড় চোপড় ক্রয়, বিয়ে শাদির কাজ সম্পন্ন, আত্মীয়তা, ডাক্তারী ঔষধপত্র সহ সকল প্রকার ব্যয় সংকুলান করতে হয়। তাদের অত্যন্ত কষ্টের ফসল, প্রত্যাশার ফসল মাঠের এই ফসল বুরো ধান। শিলা-বৃষ্টি, অকাল বন্যার কারণে যদি ত্রুটিযুক্ত এই ফসল রক্ষাবাঁধ ভেঙ্গে পানিতে ভেসে যায় অর্থাৎ সময়মত কেটে তুলে গোলায় ভরতে না পারে তবে তাদের কষ্ট ও দুঃখের সীমা থাকবে না। পরবর্তীত বছরটি কাটাতে হবে তাদের অনেক দুঃখ-কষ্ট আর অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে। যা ঘটেছিল ২০১৭ সালের অকাল ভয়াবহ মরণকালের বন্যার মাধ্যমে। তাই আমরা প্রত্যাশা করছি সুনামগঞ্জ হাওর পাড়ের কৃষকের দিকে থাকিয়ে, তাদের জীবন মানের কথা চিন্তা করে, তাদের সামান্যতম সুখ ও শান্তির কথা চিন্তা পিআইসিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাসময়ে ও সঠিকভাবেই বেড়ি বাঁধ নির্মাণের কাজগুলো অত্যন্ত আন্তরিকতা, দক্ষতা ও সততার সহিত সমাপ্ত করে কৃষককূলকে চিন্তামুক্ত করে তাদের কাঙ্কিত ফসল গোলায় তুলতে সহযোগিতা ও উৎসাহিত করবেন। মনে রাখতে হবে কৃষি ও কৃষকই হচ্ছে আমাদের দেশের চালিকা শক্তি। এরাই হচ্ছে আমাদের দেশের অর্থনীতির প্রাণ।