২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ রাত ৮:০৪

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দারিদ্র্য হ্রাসে হাতিয়ার হোক

মোঃ ওবায়েদ উল্লাহ, নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট সোমবার, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২২,

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দ স্বল্পতা, অন্য খাতে বরাদ্দের ব্যবহার এবং বাস্তবায়নে অনিয়ম নিয়ে সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় গুরুত্বসহকারে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দারিদ্র্য হ্রাসে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পন্থা। বাংলাদেশে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু থাকলেও তা এখন পর্যন্ত দারিদ্র্য হ্রাসে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য বয়ে আনতে পারেনি। এর কারণগুলো চিহ্নিত করে তা পর্যালোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দেন, যা বাজেটের ১৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং জিডিপির ৩ দশমিক ০১ শতংশ।

গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৮১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সুবিধাভোগীর সংখ্যা নির্ধারণ ও অর্থবরাদ্দ নিয়ে অর্থমন্ত্রী যেসব প্রস্তাব রাখেন সেগুলো হলো-
এক. বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা গত বছরের ৪৪ লাখ থেকে ৪৯ লাখে উন্নীতকরণ এবং ৩০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রদান।
দুই. বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারী ভাতাভোগীর সংখ্যা গত বছরের ১৭ লাখ থেকে ২০ লাখ ৫০ হাজারে বৃদ্ধি এবং ২১০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রদান।
তিন. প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৪৫ হাজার থেকে ১৮ লাখে উন্নীতকরণ এবং এ বাবদ ২২৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রদান।
চার. দরিদ্র মা’র জন্য মাতৃত্বকাল ভাতা, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহযোগিতা, ভিজিডি কার্যক্রম, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি ভাতা, অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি ও প্রশিক্ষণ, ক্যানসার, কিডনি ও লিভার সিরোসিস রোগীদের সহায়তা, চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি ইত্যাদি কার্যক্রম অব্যাহত রাখা।

এখানে লক্ষণীয়, বয়স্ক ভাতার ক্ষেত্রে পাঁচ লাখ সুবিধাভোগী বৃদ্ধির জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। এতে নতুন পাঁচ লাখ ভাতাভোগীর জন্য বছরে বরাদ্দ ছয় হাজার টাকা, যা মাসে দাঁড়ায় মাত্র ৫০০ টাকা।

তিন লাখ ৫০ হাজার নতুন বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা ভাতাভোগী এবং দুই লাখ ৫৫ হাজার নতুন প্রতিবন্ধী সুবিধাভোগীর জন্য যে পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে, তা কমবেশি বয়স্ক ভাতাভোগীর মাথাপিছু বরাদ্দের সমান।
তা ছাড়া অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যমতে দরিদ্র মায়ের মাতৃত্বকাল ভাতা, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহযোগিতা, ভিজিডি কার্যক্রম, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি ভাতা, অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি ও প্রশিক্ষণ, ক্যানসার, কিডনি ও লিভার সিরোসিস রোগীদের সহায়তা, চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি ইত্যাদি কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হলেও এসব খাতে বাড়ানো হয়নি বরাদ্দের পরিমাণ, যদিও গত এক বছরে প্রধান খাদ্য চালসহ সব নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় মাথাপিছু খুব কম পরিমাণ বরাদ্দের ফলে সব শ্রেণির ভাতাভোগীর অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না এবং তারা ‘দারিদ্র্য চক্র’ থেকে বের হতে পারছে না। সরকারি হিসাবমতে, ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে দারিদ্র্য হার হ্রাস পায় ১ দশমিক ৭ শতাংশ হারে। পরবর্তী ১০ বছরে প্রতিবছর গড়ে দারিদ্র্য হ্রাস ঘটে ১ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। দারিদ্র্য হার হ্রাসে শ্লথ গতি পরোক্ষভাবে দারিদ্র্য হার বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।

দ্বিতীয় অভিযোগটি হলো, সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দের অর্থ অন্য খাতে ব্যবহার। ৩০ জুন ডেভেলপমেন্ট জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ ও বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, চলতি অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকার ২৪ শতাংশ পেনশন এবং ৭ শতাংশ সঞ্চয়পত্রের সুদ প্রদানের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে। এর ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে সামাজিক সুরক্ষার বরাদ্দের পরিমাণ খুব কম পৌঁছে।

তৃতীয় অভিযোগ হলো, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে অনিয়ম। সরকারি সমীক্ষার বরাত দিয়ে একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বয়স্ক ভাতার তালিকায় অনিয়মের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। আর সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পুরো আয়োজনে অনিয়মের পরিমাণ ৪৬ শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বাস্তবায়নে সমস্যা ও অনিয়মগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-
এক. কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে অনেকগুলো মন্ত্রণালয়ের অধীন বহুসংখ্যক সংস্থা। এদের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয়ের অভাবে কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে।
দুই. উপকারভোগীর তালিকা প্রণয়নের দায়িত্বে থাকেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। তারা ভোট, ভোটারের চিন্তা,
আত্মীয়তার সম্পর্ক ইত্যাদি মাথায় রেখে তালিকা তৈরি করে। ফলে উপযুক্ত ব্যক্তিরা কর্মসূচির সহায়তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ভিজিডি কর্মসূচির ২৭ শতাংশ উপকারভোগী গরিব নয়। প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে বৃত্তির সুবিধাপ্রাপ্ত ৪৭ শতাংশ গরিব নয় এবং তাদেরকে ত্রুটিপূর্ণ স্বেচ্ছাচারী নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়, অন্যদিকে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে ছাত্রীদের বৃত্তির প্রায় ২০-৪০ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ উপকারভোগীর কাছে পৌঁছায় না।

তিন. দুর্নীতির কারণে সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মকাণ্ডে অর্থের অপচয় হয়। ভিজিডি, ভিজিএফ, টিআর ইত্যাদি কর্মসূচিতে দুর্নীতির খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। অনেক মন্ত্রীকে এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংসদে সোচ্চার হতে দেখা গেছে।

করোনা মহামারির কারণে দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা বেড়েছে মর্মে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সরকারি হিসাবে ২০১৯ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। একাধিক বেসরকারি গবেষণা সংস্থার হিসাবে তা ৩৫-৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সরকার থেকে এ বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়েছে বলে জানা নেই। তাই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। এ কর্মসূচির সুফল পেতে যা দরকার তা হলো-ক. কর্মসূচিতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা, খ. মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় জোরদার করা, গ. উপকারভোগী বাছাইয়ে দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করা, ঘ. দুর্নীতি দূর করা এবং ঙ. দারিদ্র্য হ্রাসের নিম্ন গতিকে ঊর্ধ্বমুখী করা।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2016 Paprhi it & Media Corporation
Developed By Paprhihost.com
ThemesBazar-Jowfhowo