বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গিয়েছিলেন আব্দুল লতিফ। চার ঘণ্টা ভেসে থাকার পর আশ্রয় নিয়েছেন ডুবে থাকা গাছের ডালে। রাত কেটেছে সেখানেই। দিনের বেলায় আবার সাঁতরে আশ্রয় নিয়েছেন ডুবে থাকা ঘরের টিনের চালায়। ক্ষুধা নিবারণের জন্য খেয়েছেন কাঁচা মাছ, লতাপাতা। এভাবে লড়াইয়ের ১৩ ঘণ্টা পর উদ্ধার পেয়েছেন একজনের সহায়তায়।
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার পশ্চিম বাজারের কর্মসংস্থান ব্যাংকের ব্যবস্থাপক আব্দুল লতিফ। গত বৃহস্পতিবার কর্মস্থল থেকে সিলেট নগরের বাসায় ফেরার পথে ভেসে গিয়েছিলেন তিনি। প্রায় ১৩ ঘণ্টা ধরে নানা সংগ্রাম শেষে একজনের সহায়তায় বেঁচে ফিরেছেন লতিফ। এ যেন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা। তাই তো দুর্বিষহ লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছেন একাধিকবার।
লতিফ জানান, দাপ্তরিক কাজ ছিল, তাই বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে ছাতকে কর্মস্থল থেকে বেরিয়ে পড়েন তিনি। ততক্ষণে টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে সিলেট-সুনামগঞ্জ আন্ত জেলা সড়ক ডুবে গেছে। অগত্যা একটি নৌকায় চড়ে বসেন তিনি। কিছুদূর এসে নৌকাটির গলুই ভেঙে যায়। নেমে এক জায়গায় দাঁড়ান। এরপর অপেক্ষা করতে থাকেন আরেক নৌকার জন্য। বিকেল ৫টার দিকে নৌকা পাওয়া যায়। সেটাতে আরো পাঁচজনের সঙ্গে চড়ে বসেন লতিফ। ১০ মিনিটের মতো চলার পর তীব্র স্রোতে নৌকা ডুবে যায়। নৌকার বাকি চারজন সাঁতরে পাড়ে উঠতে পারলেও লতিফসহ আরেকজন ভেসে যান।
এরপর ফিরে আসার গল্পটা শুনুন আব্দুল লতিফের মুখে—‘দ্বিতীয়বার নৌকায় আমরা ছয়জন ছিলাম। ১০ মিনিটের মতো এগোতেই আকস্মিক নৌকা উল্টে গেল। পানিতে পড়ে প্রবল স্রোতের প্রথম ধাক্কায়ই জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম অনেকটা। এত প্রবল স্রোত। এর বিপরীতে সাঁতারের চেষ্টা করে দ্রুত শরীর নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকে। হাল ছেড়ে দিয়ে স্রোতে ভেসে যেতে থাকি অজানা গন্তব্যে। পকেটে থাকা আইফোন, জরুরি কাগজপত্র, স্মার্ট ওয়াচ সব একে একে পানিতে তলিয়ে যায়।’
‘প্রথমদিকে বুঝতে পারছিলাম না—এ মুহূর্তে কী করা দরকার। মাথার ওপরে বিরামহীন বৃষ্টি আর নিচে ঠাণ্ডা পানির তীব্র স্রোত। কখনো ডুবছি কখনও ভাসছি। চারদিকে অন্ধকার নেমেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা গাঢ় হচ্ছে। আশপাশে পানির স্রোতের শব্দ ছাড়া কিছু নেই। অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। এভাবে প্রায় চার ঘন্টা হঠাৎ ধাক্কা খেলাম কিছুর সঙ্গে। দেখা না গেলেও বুঝে ফেললাম বড় গাছ। সঙ্গে সঙ্গে প্রাণপণে গাছের শিকড় আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলাম। ধরেও ফেললাম। কিছুক্ষণ এভাবে তীব্র স্রোতের মধ্যে শিকড় ধরে পড়ে থাকলাম। এরপর আস্তে আস্তে ডালে উঠতে সক্ষম হলাম। গাছের ডালে ঝুলে থেকে অবর্ণনীয় কষ্ট আর উৎকণ্ঠায় রাত পার করলাম। সাপের ভয়সহ নানা ভয়ে রাত কাটল।’