২২শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ রাত ১০:২২

আল মাহমুদ : শিশু-কিশোরদের মনের মতো কবি

কামরুল আলম
  • আপডেট সোমবার, আগস্ট ২৪, ২০২০,
  • 2003 বার পঠিত

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি আল মাহমুদ। অসংখ্য কবি’র ভিড়ে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। শিশু-কিশোরদের জন্যেও তিনি অনন্য-অসাধারণ এক কবি! শিশুদের তিনি পড়ার টেবিল থেকে নিয়ে যান বনবাদাড়ে। ফুলপাখিদের সঙ্গে মেতে উঠেন কবি, শিশু-কিশোর বন্ধুরাও তাঁর সঙ্গী হয়। ঘুরে বেড়ায় নদীর ধারে-বনবাদাড়ে! আর ঘুরে বেড়াবেই বা না কেন? সবাই তো ছোটোদের কেবল গালমন্দই করে। কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে চায় না! খাঁচায় বন্দি করে রাখতে চায়। শিশুদের জন্যে রয়েছে হাজারও নিষেধনামা। আল মাহমুদ শিশুদের এই বন্দিজীবনকে তাঁর ছড়ায় চিত্রিত করেছেন এভাবে-
চতুর্দিকে নিষেধনামা
চতুর্দিকে বেড়া
যেন খাঁচার লোহার জালি
কুঞ্জলতায় ঘেরা।
আম্মা লাগান গুনার বাঁধন
আব্বা লাগান দড়ি
বুবুর হুকুম বন্ধ রাখো
জানালা খড়খড়ি। (ছড়া : বন্ধ ঘরে আমি)

আবার যখন ‘পড়’ ‘পড়’ বলে সবাই শিশুদের অতিষ্ঠ করে তোলে তখন কি আর তাদের পড়ায় মন বসে? পড়ায় মন দেওয়ার কথা বলে বড়রা যতই চাপাচাপি করুক না কেন, ছোটোদের মন ঠিকই ছুটে বেড়ায় দূর থেকে দূরে। তাই আল মাহমুদ বলেন-
আম্মা বলেন পড়রে সোনা
আব্বা বলেন মন দে;
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাপার গন্ধে। (ছড়া : পাখির মতো)

পড়াশোনার মধ্যে সবচেয়ে বিরক্তির বিষয় হলো অঙ্ক! অঙ্কের ফল যদি না মিলে তাহলে মাথার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে, তাই না? কেউ কেউ আবার অঙ্ককে ভয়ও করে! ভয়ের চোটে কী অবস্থা যে হয় তা আল মাহমুদ এর ভাষায় জানা যাক-
অঙ্ক নিয়ে বসলে আমার
কখন কী যে হয়
টেবিলটাও পর হয়ে যায়
বইগুলো খুব ভয়।
ভয়ের চোটে ভাবতে থাকি
শহর ভেঙে কেউ
দালানকোঠা বিছিয়ে দিয়ে
তোলে খেতের ঢেউ। (ছড়া : ভয়ের চোটে)
.
আল মাহমুদকে ফুলপাখিদের কবি বলা হয়। প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর কী নিবিড় সম্পর্ক তা কল্পনা করাও মুশকিল! বন-বনানি, পাহাড়, জঙ্গল, ফুল-ফল ও পাখি নিয়ে আল মাহমুদের চিন্তা যে কত বিশাল এক নিঃশ্বাসে না পড়লে বোঝা কঠিন। যেমন-
নারকেলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল
ডাবের মতো চাঁদ উঠেছে ঠাণ্ডা ও গোলগাল।
ছিটকিনিটা আস্তে খুলে পেরিয়ে গেলাম ঘর
ঝিমধরা এই মস্ত শহর কাঁপছিল থরথর।
মিনারটাকে দেখছি যেন দাঁড়িয়ে আছেন কেউ
পাথরঘাটের গীর্জাটা কি লাল পাথরের কেউ?
দরগাতলা পার হয়ে যেই মোড় ফিরেছি বাঁয়
কোথ্ থেকে এক উটকো পাহাড় ডাক দিল আয় আয়।
পাহাড়টাকে হাত বুলিয়ে লাল দীঘিটার পার
এগিয়ে দেখি জোনাকিদের বসেছে দরবার।
আমায় দেখে কলকলিয়ে দীঘির কালো জল
বললো- এসো, আমরা সবাই না ঘুমানোর দল। (ছড়া : না ঘুমানোর দল)

শিশু-কিশোরদের মনের কথাগুলোই বলেছেন আল মাহমুদ। তবে এখানেই থেমে থাকেননি। শিশুদের স্বাস্থ্য সচেতন করতে উপদেশমূলক ছড়াও রয়েছে তাঁর। যেমন-
একটা ছেলে
এই ছেলেটা নখ ভরা যার মাটি
ময়লা হাতে খায় সে খাবার
ধরে দুধের বাটি।

একটা মেয়ে এই মেয়েটা
নাইতে নামে না
ছোঁয় না পানি ছোঁয় না সাবান
নোংরা ভরা গা।

এদের মতো কে হতে চায়?
কেউ হবে না ভাই
বাঁচার জন্য টগবগানো
স্বাস্থ্য থাকা চাই। (বাঁচার জন্য)
.
আবার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়েও আল মাহমুদ ছড়া লিখেছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্যে রক্ত দিয়েছিল সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারেরা। আল মাহমুদ সেই ঘটনাকে কী অসম্ভব উপমা দিয়ে চিত্রিত করেছেন! একবার পড়লেই হৃদয়ে গেঁথে যায়।
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে বৃষ্টি কোথায়
বরকতেরই রক্ত। (ছড়া : একুশের কবিতা)
.
সময়কে ধরে রাখার কোনো যন্ত্র নেই। সময় পরিমাপের যন্ত্র হলো ঘড়ি। আহা! ঘড়িটা যদি না থাকতো। ঘড়ির অত্যাচারে জর্জরিত হয়েছেন কবি এভাবে-
ঘড়ির কাঁটা থিরথিরিয়ে
আদেশ করে যা
অমনি সবাই বাইরে যেতে
বাড়িয়ে রাখে পা।

ঘড়িই বলে নাস্তা এবার
ঘড়িই করায় স্নান
সকাল বেলার জাগনাটাও
ঘড়ির অবদান। (ছড়া : ঘড়ির অত্যাচার)
.
আল মাহমুদ শিশু-কিশোরদের মনের কথা বুঝতে পারতেন। তাইতো তাঁর ছড়া-কবিতায় শিশু-কিশোরদের ইচ্ছের প্রতিধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে। কবি আল মাহমুদের পুরো নাম মীর আব্দুস আল শুকুর মাহমুদ। ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই বি-বাড়িয়া জেলায় তাঁর জন্ম। কবি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। পাশাপাশি লেখলেখির মাধ্যমেও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। কবি আল মাহমুদ শুধু কবিতা বা ছড়া লিখেই থেমে থাকেননি। লিখেছেন গল্প-উপন্যাস এবং অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ। পেশাগত জীবনে তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেছেন দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কবি আল মাহমুদ পৃথিবীর ফুল-পাখি, পাহাড়-নদীকে বিদায় জানিয়ে পাড়ি জমান অপারের ভুবনে। আল্লাহতায়ালা তাঁকে জান্নাতি ফুলের বাগানে ফুল-পাখিদের সঙ্গে বিচরণ করাবেন, এটাই আমাদের প্রার্থনা।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ

Rokomari Book

© All rights reserved © 2016 Paprhi it & Media Corporation
Developed By Paprhihost.com
ThemesBazar-Jowfhowo