
বই : স্বপ্নডানা
ক্যাটাগরি : উপন্যাস

লেখক : শাহীন শাহ

প্রকাশক: কামরুল আলম, পাপড়ি প্রকাশ, ২০১ রংমহল টাওয়ার, বন্দরবাজার, সিলেট।

প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২১

প্রচ্ছদ : মোয়াজ্জিম আল হাসান

মূল্য : ২৫০ টাকা

রিভিউ : বাসিত মুনতাসির

ব্যক্তিগত রেটিং : ৪/৫
স্বপ্ন। আমাদের মনের গহীনে থাকা চিন্তা, ভবিষ্যতের কথা, অব্যক্ত বাসনার চিত্রময় প্রকাশ। অনুপ্রেরণা মন জাগাবার, আলো দেখার অনুভূতি, ভাবনা। এই আশা, স্বপ্ন, আর অনুপ্রেরণা আছে বলেই আমরা মানুষ।
মেধা আল্লাহ তা’লার প্রদত্ত আমাদের জন্য এক বড় নিয়ামত। এই মেধার বলেই চিন্তা, কল্পনা, ইচ্ছা, বাসনাশক্তিকে কাজে লাগাতে পারি বলে আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব। তাই আমাদের সকলের উচিত যার দয়ায় আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠতা পেয়েছি তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এই আর্বজনা মুক্ত একটা সমাজ উপহার দেওয়া।
আমরা অনেক শুনেছি কেউ দিনমজুর, গৃহকর্মীর কাজ করেছে, কেউ নিজে কোচিংয়ে না পড়ে উল্টো অন্যদের পড়িয়েছে আর কত কি কাজ । যে কাজই করুক, সঙ্গে ছিল শুধু বড় হওয়ার অদম্য ইচ্ছা। সেই ইচ্ছা পুষে রাখতে জীবনসংগ্রামের কঠিন সব পথ বেছে নিতে হয়েছে তাদের। দেশের আনাচে-কানাচে থাকা এসব অদম্য মেধাবীদের কথা আমরা অহরহ শুনেছি পত্রিকার পাতায়। কিন্তু স্বপ্নডানা উপন্যাসের নায়ক আইনুলের গল্পেরটা এই সমাজে অহরহ হলো সাফল্য মুখ খুব কম মানুষে মুখে শুনে যায়। চুরে ছেলে কি কখনো বড় কোন পুলিশ অফিসার হবে সেটা হয়তো গ্রামের মানুষ কখনো কল্পনা করতে পারেন নি।
লেখক উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক খেটেখুটে খাওয়া মানুষের জীবন কে তুলে ধরছেন। যার দাচ কি সবার দ্বারা সম্ভব। কখনো হয়তো সম্ভব না। লেখকের তার লেখার কিছু করুণ কথা তুলে ধরছেন। আমাকে অশ্রু সিন্ধ করতে বাধ্য করছে। সমাজ, সমাজ আর সমাজ। আসলে তো আমাদের সমাজ কি কখনো আমাদের কে কিছু দিতে পেরেছে। আমি ভুল করলে সমাজ দেখবে, আমার পেটে খিদায় চু চু করলে সমাজ কেন দেখবে না। সেটার এক বড় ইঙ্গিত দিয়েছেন লেখক তার উপন্যাস।
একদম শিশুকাল থেকে শুরু করে কৈশোরে দূরপাল্লার ট্রেনে গতি কতটুকু মসৃণ আমি কতবার আমার নিজের ছোটবেলা চলে গেছি বলে বুঝাতে পারবো না। গ্রামীন জীবন, বৃষ্টিদিনে টুপুরটুপুর বৃষ্টি শব্দ, ধানেরক্ষেত্রে কত মাছ ধরছে, কত খেলাধুলা করছি, কাঁদাছুড়াছড়ি করছি আর চোখের সামনে জলজল করছে সেই কৈশোরে দূরপাল্লার দিনগুলি।
লেখক শাহীন শাহ তাঁর স্বপ্নডানা উপন্যাস কে একটি মোটিভেশাল বই বলতে পারি। আইনুলের জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া অনেক কিছু আছে এই উপন্যাসে ভিতরে। একটা পরিবার তাদের অভাব, অভিযোগ কতটা তারা নিপীড়নের শিকার ,তারপর তাদের কোন অভিযোগ নাই। সেটা তুলে ধরছেন। একজন পাকাপোক্ত খেলোড়ি ছাড়া কেউ তুলে ধরতে পারবে বলে মনে করি না।
বইটিতে কিছু কথা আমার মনে ধরছে প্রথমদিকে মা আমি বারে যামু, মুতমু….!
ভারতচন্দ্র রায়গুনাকর এর আমার সন্তান কবিতায় দেখা যায় ঈশ্বরী পাটনী নিজের স্বার্থকে গুরুত্ব না দিয়ে সন্তানের সুখ-সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করেছেন। একদিন এক ছদ্মবেশধারী দেবী পাটনীর নৌকায় পার হওয়ার জন্য ওঠেন। পাটনীর কথাবার্তায় দেবী অন্নপূর্ণা খুশি হয়ে বর প্রার্থনা করতে বলেন। ঈশ্বরী পাটনী ইচ্ছা করলে সোনা-মহর-ধন-সম্পদ যা খুশি তাই চাইতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে সন্তানের মঙ্গলের কথা ভাবলেন এবং দেবীর কাছে বর চাইলেন
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। ঠিক তেমনি স্বপ্নডানা উপন্যাস আইনুলের মা ছেলের জন্য একিরকম চাইলেন। সন্তানের মুখে যেন দুমুঠো ভাত দিতে পারেন বলে সারাদিন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজের জন্য ঘুরিয়েছেন কিন্তু ঠিক সেই হারুর মা তাকে চমকই দিলেন মুখে হাসিফুটিয়ে দিলেন তখন আইনুলের মা বলেন চাচি নিজে না খেয়ে কাটাবে কিন্তু ছেলেটার জন্য একমুঠো ভাত চাই।
একজন উপকার করলে তার উপকার সয়ং আল্লাহ সাহায্য করেন। এটা আমরা বিশ্বাস করি। আইনুলের বাবা চুরি করতে গিয়ে মারা যাওয়ার পর তাদের একবেলা খাবার যেখানে জুটেছিলো না সেখানে পড়াশোনা করা বিলাসিতা ছাড় কিছু না তারপর আইনুল পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। যার বাপ একটা চুর। সেই অপবাদটা থাকে একটা সময় অসামাজিক করে দিয়েছিলো। কিন্তু মনজু স্যার যদি এই মাথার ভিতরে দৈত্য কে না জাগাতেন তাহলে গল্প নিহাত সাবলীল কোন পাড়ার কাহিনির মতো হয়ে যেতো হয়তো। আমরা অনেক সিনেমাতে দেখিছি শাবানা আর জসিম খুব গরীর খেতে পারছেন না। কিন্তু হঠাৎ লটারি পেয়ে কোটিপতি। সেটা যেমন অবাস্তব। কিন্তু আমাদের চারপাশে এইরকম হাজারো নায়ক আজ শুধু নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ কুটির মতো আলো নিমুঝিমু করছেন। তারা নিজের জীবনকে সঠিক মাঠ আর খেলার নিয়মটা জানেন না বলে তারা অকৃতকার্য হিসাবে সমাজের আখ্যা পাচ্ছেন।
আইনুল যখন রাজশাহী বোর্ডে সেকেন্ড স্ট্যান্ড করলো হারুর মায়ের আনন্দ হয়তো উনি বুঝে করুক আর নাই বুঝে করুন সেটা কিন্তু গল্পের একটা চমক ছিলো। আইনুলের জীবন আর বাস্তবতা অনেকটা খানি আমার চোখের সামনে মনে হলো চরম বাস্তব জীবন নামের রেলগাড়িতে শুধু সঠিক একজন মানুষের ভিতরে জেদ আর আত্মবিশ্বাসী না হলো নিজের লক্ষ্য কখনো উঠা সম্ভব হবে না।
পরিশেষে বলবো কাঞ্চনজঙ্ঘা উপরে উঠার চেয়ে বিশাল বালুচরে বসাবাসা করা উচিত। কাঞ্চনজঙ্ঘা শুধু তুমি একা থাকবা, আর বালুচরে তুমি সবাইকে নিয়ে থাকতে পারবে।
স্বপ্নডানা বইটি মমিরপুতুলের মতো নিজের জীবনকে কতটুকু ভেঙেচুরে নতুনভাবে উঠে দাঁড়াতে তৈরি করবে প্রতিটা তরুন ছেলেমেয়েদের জন্য একটা আত্মবিশ্বাসী বই বলতে পারি। না পড়লে কখনো বলে বুঝানো সম্ভব না।
লেখক সম্পর্কে বলি উনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। উনি বর্তমানে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) কৃষি ক্যাডার ৩৬ তম ব্যাচ কৃষি কর্মকতা হিসাবে নিয়োজিত আছেন।
লেখকদের কর্মজীবন এবং আগামীতে দাম্পত্যজীবন সুখকর হোক। আর স্বপ্নডানা যেন সবার স্বপ্নের আঙ্গিয়ায় রাঙিয়ে তুুলুক সে প্রত্যাশা রাখি।
বাসিত মুনতাসির
মিরের ময়দান, সিলেট
০৪ জুলাই ২০২১ খৃ: