১লা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ সকাল ১১:২৭

চিঠি দিবসের ভাবনা

কামরুল আলম
  • আপডেট শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ১, ২০২৩,
আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে চিঠির যুগে। তারও আগে একসময় কবুতর মারফত বার্তা প্ররণের যে কাহিনি শোনা যায় তা আমাদের যুগে মোটেই ছিল না। আমরা ডাকঘর পেয়েছি, রানার পেয়েছি। কবি সুকান্তের ‘রানার’ কবিতাটির অংশ বিশেষ মুখস্থ ছিল আমার।-
রানার ছুটেছে তাই ঝুম্‌ঝুম্ ঘন্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,
রানার চলেছে, রানার !
রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার ।
দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার-
কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।
.
হ্যাঁ, আমাদের কাছে নতুন খবর চিঠির মাধ্যমেই আসত। হোক সেটা বিদেশ থেকে, রাজধানী থেকে কিংবা জেলা শহর থেকে। এমনকি পার্শ্ববর্তী উপজেলা, ইউপি বা গ্রাম থেকেও চিঠি আসত। কারণ চিঠির বিকল্প ছিল না। একটাই বিকল্প ছিল যা হচ্ছে সরাসরি লোক মারফত বার্তা প্রেরণ। যেমন- কেউ মৃত্যুবরণ করলে চিঠির মাধ্যমে নয়, বরং আত্মীয়-স্বজনের নিকট লোক পাঠানো হতো। এসময় পাড়া-প্রতিবেশির অনেকেই এগিয়ে আসতেন, দূরে কোথাও কারো কাছে খবর পৌঁছাতে হবে কি না, যদি কোনো সহযোগিতা লাগে। আমার নানার মৃত্যু সংবাদ শহরে আসার পরে এভাবেই পেয়েছিলাম। গ্রামের বাড়ি থেকে শহরের বাসার দূরত্ব প্রায় ৭০ কি.মি। এতটা পথ পেরিয়ে একজন লোক এসে যখন কলিংবেল বাজিয়ে জানাল, কামরুল তোমার নানা আর নেই! তখন আমাকেই দায়িত্ব নিতে হলো শহরের অন্যান্যদের কাছে বার্তাটি পৌঁছে দেওয়ার। এরকম পরিস্থিতিতে চিঠি কাজে লাগত না। তবে বিদেশে অবস্থানরত আত্মীয়-স্বজনকে চিঠি লিখে জানিয়ে দেওয়া হতো।
..
আমাদের যুগের আরেকটু আগের যুগের ঘটনা। আমার আব্বা মরহুম কবি মাস্টার করামত আলী যখন ক্লাস নাইনের ছাত্র তখন তাঁর পিতা অর্থাৎ আমার দাদা ইন্তেকাল করেন। আব্বার তখন বার্ষিক পরীক্ষা চলছিল। আমাদের পার্শ্ববর্তী উপজেলার (কানাইঘাট, সিলেট) একটি হাইস্কুলে তিনি পড়াশোনা করতেন। তাঁর বার্ষিক পরীক্ষা চলাকালেই দাদার মৃত্যু হওয়ায়, এলাকার ময়-মুরব্বিরা ঠিক করলেন, ওকে খবর দেওয়ার দরকার নেই। জানতে পারলে পরীক্ষা খারাপ করবে। অতএব পরীক্ষা শেষ করে আব্বা বাড়িতে ফিরে জানতে পারলেন, তাঁর বাবা আর বেঁচে নেই। এ ঘটনাটি আমি আমার আব্বার কাছ থেকেই জেনেছি।
চিঠি দিবসে মনে পড়ছে আমার প্রথম চিঠি লেখার ঘটনাগুলো। তখন মাত্র বাংলা লেখা শিখেছি। বড়োভাই সিলেট শহরে থাকতেন পড়াশেনার জন্য। নিয়মিত আব্বার কাছে চিঠি পাঠাতেন। আব্বাও ফিরতি চিঠি লিখতেন। তাঁদের চিঠির মধ্যেই আমাদের খোঁজ খবর হয়ে যেত। মাঝেমধ্যে আম্মাকে আলাদা করে চিঠি লিখতেন বড়োভাই। তো আমার শখ ছিল, আমিও চিঠি লিখব। লজ্জার মাথা খেয়ে আব্বাকে একদিন বলে ফেললাম! আব্বা বললেন, তা বেশ তো, তুমিও লেখো। সেই বড়োভাইকে সম্বোধন করে চিঠি লিখতে শুরু করলাম। কতবার যে কেটেছি আর ঠিক করেছি, নতুন করে লিখেছি তার ঠিক নেই। ‘এলাহী ভরসা। ভাই, আসসালামু আলাইকুম। আশা করি আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন। আমরাও একপ্রকার ভালো আছি। যাক পর সংবাদ এই যে…।’ এতটুকু লেখার পর আর কোনো বিশেষ সংবাদ খুঁজে পেতাম না লেখার জন্য। চিঠিগুলো আব্বার কাছে দিতাম। আব্বা পাঠাতেন। মাঝে মাঝে ভাইয়ের ফিরতি চিঠিও আসত। পড়াশোনা করার পরামর্শটাই বেশি দিতেন।
একসময় সিলেট শহরেই চলে এলাম। সিলেট শহরের বাসায় এসে উঠলাম ১৯৯৫ সালে। তখনও কিন্তু চিঠির যুগই চলছে। কিন্তু কেউ আমাকে চিঠি লেখে না। আগে যে ভাইয়ের কাছে চিঠি লিখতাম এখন তাঁর বাসাতেই থাকি! তো চিঠি কে লিখবে, কাকে লিখব! একদিন বন্দর বাজার হেড পোস্ট অফিসে গিয়ে নিজেই নিজের কাছে একটি চিঠি লিখলাম। ব্যাস, মাত্র দুদিন পর চিঠিটি আমার বাসায় চলে এলো! ওহ! দারুণ লেগেছিল দুই টাকার হলুদ খামটি খোলার পর।
১৯৯৭ সাল থেকে লেখালিখিতে জড়িয়ে পড়ি। দেশের প্রায় প্রতিটি পত্রপত্রিকা ও লিটলম্যাগে লেখা পাঠাতাম ডাকযোগে। সেই সূত্রে বহু লেখকবন্ধু তৈরি হয়ে গেল। তারাও চিঠি পাঠাত। পত্রমিতালী নামে একটি ম্যাগাজিনও ছিল। ওটাতে অনেকের ঠিকানা, পেশা ও প্রিয় শখ উল্লেখ করা থাকত। একবার রাঙ্গামাটির এক পত্রবন্ধুর সঙ্গে মারাত্মক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল! পরে সেই বন্ধুটি আর পত্র পাঠায় না। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম!
২০০১ সালে ছোটোদের ছোটোকাগজ ‘কচি’ বের করি। কচির জন্য লেখা আহ্বান ছাপা হয়েছিল দৈনিক ইনকিলাবের ‘সোনালি আসর’, সংগ্রামের ‘নীল সবুজের হাট’, বাংলাবাজার পত্রিকার ‘হইচই’ ও ‘চাঁদের হাট’ পাতাসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। সেই সুবাদে প্রচুর লেখা ডাকযোগে আসতে শুরু করে আমার বাসার ঠিকানায়। এমন ঘটনা ঘটবে কল্পনাও করিনি। সবচেয়ে বেশি সাড়া পেয়েছিলাম ইনকিলাবের ‘সোনালি আসর’ পাতা থেকে। সপ্পাহের সাতদিনই একগাদা চিঠি নিয়ে আসত ডাকপিয়ন। আমার বাসা ছিল তিনতলায়। সে রাগ করে বলল, সাংবাদিক সাহেব! আপনার এত চিঠি তো তিনতলায় প্রতিদিন নিয়ে দিতে পারব না। আপনি বাসার নিচে এতটা ডাকবাক্স লাগান। তখন উপায়ন্তর না পেয়ে কাঠমিস্ত্রিকে দিয়ে একটি ডাকবাক্স বানাতে হয়েছিল। হায়, সেই দিনগুলো যদি আবার ফিরে আসত!
সময়ের ঘোড়া এগিয়ে যেতে থাকল। ধীরে ধীরে মোবাইলের যুগে প্রবেশ করল পৃথিবী। আমিও ব্যতিক্রম না। ব্যক্তিগত মুঠোফোন হাতে পেলাম ২০০৩ সালে। তখনও চিঠিপত্র কমবেশি আদান-প্রদান হতো। তবে ইমেইল সার্ভিসও চালু হয়ে গিয়েছে ততদিনে। ‘সাইবার ক্যাফে’-তে ঘন্টা ৩০ টাকায় কত বসেছি, তা এ প্রজন্মের কাছে তো অজানাই থেকে গেল!
যুগটা ডিজিটাল হয়ে গেল। ডাকঘর বাদ দিয়ে ইমেইল ও কুরিয়ার সার্ভিসের দিকে ঝুঁকে পড়লাম। ধীরে ধীরে এন্ড্রয়েড ফোনও এসে গেল। আমি অবশ্য নেটজগতে এন্ড্রয়েডের বহু বহু আগে থেকেই ছিলাম। ফেসবুকে এসেছি ২০০৯ সালে। ডেস্কটপ আর ল্যাপটপেই নেট চালাতাম। ব্লগিং করেছি ২০১০-২০১৩ পর্যন্ত। এরপর ফেসবুকটাই মিনি ব্লগে পরিণত হয়ে যায়। সবকিছু আজ ফেসবুকময়।
চিঠি দিবসের কথাগুলো চিঠির মাধ্যমে কাউকে জানানোর সুযোগ হলো না। ফেসবুকেই ছেড়ে দিলাম। আশা করছি এ যুগের ফেসবুকাররা কিছুটা হলেও সে যুগের একটা চিত্র আঁকতে পারবেন হৃদয়পটে। আর সে যুগের বন্ধুরাও কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে যাবেন ফেলে আসা সোনালি অতীতে।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2016 Paprhi it & Media Corporation
Developed By Paprhihost.com
ThemesBazar-Jowfhowo