১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ সকাল ৮:৩২

খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল, বর্গি এল দেশে

মোসতাকিম হোসেন
  • আপডেট সোমবার, আগস্ট ২৪, ২০২০,

খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল/ বর্গি এল দেশে, / বুলবুলিতে ধান খেয়েছে / খাজনা দেব কিসে?
মা-নানি-দাদির মুখে ছেলেবেলায় এই গান শুনতে শুনতে নিশ্চয় অনেকবার ঘুমিয়ে পড়েছ!  কারও কারও নিশ্চয় মনে হয়েছে, এই বর্গি আবার কারা? তাদের এত ভয় পাওয়ার কী আছে? উত্তরটা দেওয়ার আগে চলো একটু টাইমমেশিনে চড়ে আড়াই শ বছর আগে চলে যাই।

তখন বাংলায় চলছে আলিবর্দি খাঁর যুগ। আলিবর্দি খাঁকে চেনো তো? সেই যে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা, সেই সিরাজউদ্দৌলার নানা হলেন এই আলিবর্দি খাঁ। তো খাঁ সাহেবের রাজত্বে বাংলার মানুষের অভাব হয়তো ছিল, কিন্তু অশান্তি ছিল না তেমন। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই বাংলার আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা!

কথা নেই, বার্তা নেই, একদল লুটেরার উৎপাত শুরু হয়ে গেল মুর্শিদাবাদের গ্রামগুলোতে। রাতের আঁধারে একদল লোক ঘোড়া টগবগিয়ে হানা দিতে থাকল। তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে থাকল, লোকজনকে মেরে-ধরে সবকিছু কেড়ে নিতে থাকল। দোকানপাট সব তাদের অত্যাচারে বন্ধ হয়ে গেল, মানুষজন ভয়ে ঘর থেকে বেরুনো বন্ধ করে দিল। শান্ত বাংলা যেন হঠাৎ করেই আতঙ্কের বাংলা হয়ে উঠল। কিন্তু এই লুটেরাদের দল আবার উদয় হলো কোত্থেকে?

এই দুবৃ‌র্ত্তরাই কিন্তু তোমাদের ছড়াগানের সেই বর্গি। এই বর্গি শব্দটা এসেছে ফারসি ‘বারগিস’ থেকে, যেটার অর্থ ‘প্রাচীন মারাঠা যোদ্ধা’। বুঝতেই পারছ জাতে তারা মারাঠি। হাতে তাদের থাকত তীক্ষ্ণফলা বর্শা। মারাঠাদের আসল নিবাস ভারতের মহারাষ্ট্র শহরে হলেও দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতজুড়েই কিন্তু তারা ছড়িয়ে। আলিবর্দি খাঁ যখন বাংলার সিংহাসনে, সে সময় দিল্লির তখতে ছিল মোগলরা। সে সময় এই মারাঠাদের যোদ্ধা হিসেবে নামডাক ছিল। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মোগলদের সঙ্গে মারাঠাদের ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছিল। এই মারাঠাদের কিছু পথচ্যুত সেনাই একসময় পরিচিত হয়ে যায় বর্গি নামে। ভারতজুড়েই তারা শুরু করে তাণ্ডব।

সেই তাণ্ডবের ঢেউ বাংলায় এল কীভাবে? এখানেও একটু ইতিহাসের কচকচানি শোনাতে হচ্ছে। আলিবর্দি খাঁ বাংলার নবাব ছিলেন, সেটা তো আগেই বলেছি। শ্যালক রুস্তম জং ছিলেন উড়িষ্যার উপশাসক (নায়েবে আজম)। কী এক কারণে রুস্তম জং বলে বসেন, ‘না, আমি খাঁ সাহেবের কতৃ‌র্ত্ব মানি না।’ তখনকার দিনে যেটা হতো, এ রকম বিদ্রোহ করলে যুদ্ধ ছিল একেবারে অনিবার্য। তো যুদ্ধ হলো, সেই যুদ্ধে রুস্তম ভগ্নিপতির কাছে হারও মানলেন। আলিবর্দি খাঁ তাঁকে উপশাসকের পদ থেকে সরিয়ে দিলেন। রুস্তম তখনকার মতো রণেভঙ্গ দিলেন, কিন্তু তক্কে তক্কে ছিলেন কী করা যায়।

সেই সময় নাগপুরের রাজা ছিলেন রঘুজিৎ ভোঁসলে। রুস্তম ভোঁসলেকে গিয়ে ধরলেন, উড়িষ্যা তার ফেরত চাই-ই চাই। ভোঁসলের সাহাযে্য রুস্তম আবার উড়িষ্যা দখল করলেন। কিন্তু রুস্তমের কপালে বেশিদিন সুখ সইল না। আলিবর্দি খাঁ আবারও রুস্তমকে হারিয়ে উড়িষ্যা নিজের কব্জায় নিয়ে নেন।  এদিকে সর্বনাশ যা হওয়ার তা কিন্তু হয়ে গেছে। কিছু বিপথগামী মারাঠা সৈন্য এসে পড়েছে বাংলায়। সালটা ছিল ১৭৪২। তারা এসেই শুরু করে দারুণ অত্যাচার। নিরীহ মানুষজনকে ধরে ধরে মেরে ফেলতে থাকে। এই বর্গিদের সর্দার ছিলেন ভাস্কর পণ্ডিত।

আলিবর্দি খাঁ খবর পেলেন, মুর্শিদাবাদে এ রকম বর্গিরা আক্রমণ করেছে। বর্গিদের ঠেকাতে সৈন্যসামন্ত নিয়ে চলে এলেন নবাব। কিন্তু বর্গিরা ছিল ভীষণ দুর্ধর্ষ। নবাবের বাহিনীকে ঘিরে রেখে তারা সব রসদের পথ বন্ধ করে দেয়। সেবার অনেক কষ্টে বর্গিদের হাত থেকে নিস্তার পান নবাব।

কিন্তু আক্রমণ তো আর কমে না। তারা লুটতরাজ চালিয়ে যেতে থাকে গ্রামে গ্রামে। আলিবর্দি খাঁ এবার সৈন্যসামন্ত বাড়িয়ে তাদের দেশছাড়া করতে আসেন। কিন্তু বর্গিরা কি এত সহজে পিছু হটার পাত্র? মুর্শিদাবাদ থেকে তারা পালিয়ে যায় দক্ষিণে হুগলিতে। সেখানে গিয়ে তারা নতুন করে আস্তানা গাড়ে। গ্রামবাসীর কাছ থেকে জোর করে খাজনা বা কর আদায় করতে থাকে। (বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে—এই খাজনা কোত্থেকে এসেছে বুঝতে পারছ?)

এদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য তখন লাটে ওঠার জোগাড়, মানুষ না খেতে পেয়ে মরার পথে। আলিবর্দি খাঁ কম চেষ্টা করেননি তাদের পরাস্ত করতে। একবার তো কূটকৌশলের আশ্রয় পর্যন্ত নিয়েছিলেন। আলোচনা করার জন্য ২১ জন বর্গিসহ ভাস্কর পণ্ডিতকে আমন্ত্রণ জানান নিজের তাঁবুতে। আমন্ত্রণ রক্ষা করতে এলে তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় নবাবের লোকেরা। ভাস্কর পণ্ডিত মারাও যান, কিন্তু লাভের লাভ কিছু হলো না।  কিন্তু এত কিছু করেও বর্গিদের টলানো যায়নি। পরে রঘুজি ভোঁসলে নিজেই বাংলা আক্রমণ করেছিলেন। দুর্ধর্ষ বর্গিরা কিছু সময়ের জন্য পিছু হটলেও বাংলা ছাড়ল না, ঘুরে ঘুরে চালাতে লাগল তাদের দস্যুবৃত্তি।

এভাবে ১৭৪২ থেকে শুরু করে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বর্গিদের উৎপাতে মানুষ তটস্থ ছিল। কিন্তু তারা বিদায় নিল কীভাবে? একরকম ‘ত্যাগ’ স্বীকার করেই কিন্তু ওদের দূর করতে হয়েছে। ১৭৫১ সালে এক চুক্তির অংশ হিসেবে আলিবর্দি খাঁ বর্গিদের হাতে উড়িষ্যা ছেড়ে দেন। বাংলা থেকে দূর হয় একটা অভিশাপের। কিন্তু এই নয় বছরে যে ত্রাস তারা চালিয়েছিল, সে জন্য তাদের নামে লেখা লোকগানটা পাকাপাকিভাবে ঠাঁই পেয়ে যায় এ অঞ্চলের ইতিহাসেই।

এবার বুঝলে তো, বর্গিদের নামে বাংলা কেন থরহরি কম্পমান ছিল!

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2016 Paprhi it & Media Corporation
Developed By Paprhihost.com
ThemesBazar-Jowfhowo