২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ রাত ৪:১৮

আমাদের পল্লী কবি জসিম উদ্দীন

আফতাব চৌধুরী
  • আপডেট রবিবার, জানুয়ারি ১৭, ২০২১,

পল্লী কবি জসিম উদ্দীন ১৯০৩ সালের ১লা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। জসিম উদ্দীনের পিতার নাম আনছার উদ্দীন আহমদ ও মায়ের নাম আমেনা খাতুন।
গোবিন্দপুর গ্রামটি ছিল খুব সাধারণ একটি গ্রাম। ফরিদপুর জেলার এ গোবিন্দপুর গ্রামে বড় হয়েছেন জসিম উদ্দীন। গোবিন্দপুরের পাশে শোভারামপুর গ্রামে ছিল একটি পাঠশালা। পাঠশালাটির নাম ছিল অম্বিকা পণ্ডিতের পাঠশালা। এ পাঠশালা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করলেন জসিম উদ্দীন। এরপর তিনি ভর্তি হন ফরিদপুর জেলা শহরের হিতৈষী বিদ্যালয়ে। সে সময় এটি ছিল একটি নামকরা মধ্য ইংরেজী বিদ্যালয়। জসিম উদ্দিনের পিতা আনছার উদ্দীন আহমদও তখন এ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। শিক্ষক হিসেবে তাঁর যথেষ্ট নাম ডাক ছিল। আনছার উদ্দীন আহমদ ছিলেন অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। শুধু তাই নয়, দায়িত্ব পালনেও ছিলেন কঠোর, কর্তব্যের গাফিলতি তিনি একদম সহ্য করতে পারতেন না।
ছোটবেলায় জসিম উদ্দীন খুব দুরন্ত ছিলেন। চাচাতো ভাই নেহাজ উদ্দীন ছিল তার সারাক্ষনের সঙ্গী। তিনি তাঁকে সঙ্গে নিয়ে সারা গ্রাম চষে বেড়াতেন। কোন পাড়ায়, কার বাড়িতে কূল পেকেছে, জঙ্গলে কোথায় কাউয়া টুটি (এক প্রকার ফল) পেকেছে নেহাজ উদ্দীন এসব খবর সংগ্রহ করে আনতো আর তারপরই দু জন মিলে ছোটে যেতেন কুল পাড়তে। গ্রামবাসীরা দুরন্ত পণায় অতিষ্ট হয়ে প্রায়ই বাড়িতে গিয়ে নালিশ করতেন জসিম উদ্দীনের নামে। বিরক্ত হয়ে মাঝে মধ্যে তাঁকে ঘরের ভিতর আটকে রাখা হত, সঙ্গে নেহাজ উদ্দীনকেও।
শৈশব থেকেই জসিম উদ্দীন ছিলেন কিছুটা আত্মভোলা স^ভাবের। পোষাক পরিচ্ছদ পরতেন খুব সাধারণ, দামী পোশাকের প্রতি তাঁর কোনও আকর্ষন ছিল না। শৈশবে তাঁর জীবনে এসেছিলেন একজন পীর। সে পীরের প্রতি তাঁর অন্ধ বিশ্বাস ছিল। সে সময় তিনি খালি পায়ে হাটতেন এমনকি অনেক সময় কোনও জামাও গায়ে দিতেন না। শুধু এক টুকরো সাদা কাপড় গায়ে জড়িয়ে জামার কাজ চালাতেন।
জসিম উদ্দীন গল্প-কাহিণী শুনতে খুব ভালবাসতেন। জসিম উদ্দিনের পিতার এক চাচা ছিলেন অন্ধ, নামে দানু মোল্লা। দানু মোল্লা লেখাপড়া না জানলেও অনেক গুনের অধিকারী ছিলেন। তিনি নানা ধরণের গল্প কাহিনী জানতেন। সে গল্প গুলো এমন রসালো করে বলতেন যে, জসিম উদ্দীন এ গল্প শুনার জন্য প্রায়ই ছুটে যেতেন দানু মোল্লার কাছে। কবি গান ছিল জসিম উদ্দিনের সবচেয়ে প্রিয় গান। কবি গান হল দু’দল কবির মধ্যে ছন্দোবদ্ধ গানের ভিতর দিয়ে তর্কযুদ্ধ। একদল প্রশ্ন করতেন আরেকদল তার জবাব দিতেন গান ও কবিতার মাধ্যমে। আর এ প্রশ্ন আর জবাবের মাধ্যম হলো গানের ছন্দ এবং সুর। কোথাও কবি গানের আসর বসবে শুনলে তিনি আর স্থির থাকতে পারতেন না। যেমন করেই হোক সেখানে হাজির হতেন। কবি গান শুনতে গিয়ে রাতের পর রাত কাটিয়ে দিতেন। এ জন্য পিতার কাছে বকুনিও খেতেন। কবি গান শুনার পর বাড়িতে এসে তা নিয়ে সারাক্ষণ ভাবতেন। মনে মনে গানের ছন্দের মত ছন্দ মিলিয়ে নিজে লিখতেও চেষ্টা করতেন।
এভাবে কবি গান শুনতে শুনতে জসিম উদ্দীন লিখতে শুরু করলেন। ধীরে ধীরে তার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। ক্রমে একদিন তিনি বড়মাপের পল্লী কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করলেন। জেলা স্কুলে পড়ার সময় থেকেই জসিম উদ্দীন কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন। সে সময় স্কুলে ক্ষীরোদবাবু নামে একজন শিক্ষক এসেছিলেন। তিনি ছিলেন খ্যাতিমান কবি। জসিম উদ্দীন মাঝে মধ্যে ছুটে যেতেন ক্ষীরোদবাবুর কাছে। কবিতার নানাদিক নিয়ে আলোচনা করতেন। ক্ষীরোদবাবু জসিম উদ্দিনের লেখা মন দিয়ে শুনতেন এবং তাকে লেখার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন।
১৯২১ সালে প্রবেশিকা পাশ করার পর জসিম উদ্দীন ভর্তি হন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে। এ কলেজ থেকে তিনি ১৯২৪ সালে আইএ পাশ করেন। এসময়ে জসিম উদ্দীন অনেকটা খেয়ালের বশে গ্রাম বাংলার পল্লী সাহিত্যের উপকরণ সংগ্রহে মনোযোগ দেন। কিছুদিনের মধ্যেই পল্লীর অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত কবিয়ালদের রচিত বহু গীত, শ্রুত, সংগীত, কাহিনী এবং কবিতা সংগ্রহ করেন। এ বিষয়ে তাকে উৎসাহিত করেছিলেন তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক দীনেশ চন্দ্র সেন। জসিম উদ্দীন যখন দশম শ্রেনীতে পড়তেন সে সময় তিনি তার বিখ্যাত কবর কবিতাটি রচনা করেছিলেন। কবিতাটি কল্লোল পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এ কবর কবিতাটি পড়ে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছিলেন ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন। তিনি কবিকে লিখেছিলেন দূরাগত রাখালের বংশী ধ্বনির মত তোমার কবিতা আমার অন্তরকে পর্শ করেছে। তোমার কবিতা পড়ে আমি কেঁদেছি।
জসিম উদ্দীন যখন রাজেন্দ্র কলেজে বি এ ক্লাসের ছাত্র তখন ডঃ দীনেশচন্দ্র সেনের আন্তরিক চেষ্টায় কবর কবিতাটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সিলেকশন বইয়ে সংকলিত হয়। রাজেন্দ্র কলেজ থেকে বি এ পাশ করার পর জসিম উদ্দীন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ক্লাসে ভর্তি হলেন।
জসিম উদ্দিনের প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা অর্ধশতাধিক। তার মধ্যে রাখালী, নকশী কাথার মাঠ, বালুচর, ধানক্ষেত, রঙ্গিলা নায়ের মাঝি, সোজন বাদিয়ার ঘাট, হাসু, রূপবতী, পদ¥াপার, এক পয়সার বাশী, মাটির কান্না, সকিনা, ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিণায়, জার্মানীর শহরে বন্দরে ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তার স¤পাদিত গ্রন্থের মধ্যে জারীগান ও মূর্শিদী গান বিশেষভাবে দখল করে আছে বাংলা সাহিত্যে।
নকশী কাঁথার মাঠ জসিম উদ্দিনের একটি সুবিখ্যাত কাহিনী কাব্য। এক সময় কবি হিসেবে জসিম উদ্দিনের খ্যাতি শুধু দেশেই নয়-বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। পৃথিবীর নানা ভাষায় অন–দিত হয়েছে তাঁর নকশী কাথার মাঠ কাব্য গ্রন্থটি। প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল বিভাগের প্রধান জুশন জবাভিতেল চেক ভাষায় এর অনুবাদ করেন।
১৯৩৯ সালে নকশী কাঁথার মাঠ প্রকাশের দশ বছর পর বিদেশিনি মহিলা মিসেস ই এম মিলফোর্ড এ কাব্যের ইংরেজী ভাষ্য The Field of the Embroidered Quilt প্রকাশ করেন। এ অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর জসিম উদ্দীন আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন।
জসিম উদ্দীন সত্যিকার অর্থেই ছিলেন একজন খাটি পল্লী কবি। তিনি অন্তর দিয়ে মানুষকে ভালবাসতেন। তাই তাঁর কবিতায় সে ভালবাসার চিত্রই ফুটে উঠেছে।
১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ পল্লীকবি জসিম উদ্দীন এ পৃথিবী ছেড়ে চিরদিনের মত বিদায় নিলেন। কিন্তু তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিনি অমর হয়ে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2016 Paprhi it & Media Corporation
Developed By Paprhihost.com
ThemesBazar-Jowfhowo