প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে দেখে নিলেন সুরুজ মিয়া। শূন্য মানিব্যাগের এককোণে একটি পাঁচ টাকার পয়সা পড়ে আছে।
অথচ সকালে বাসা থেকে বের হবার সময় তার একমাত্র মেয়ে, মিলি গরুর গোসত নিতে কেঁদে কেঁদে বলেছিল। এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে একটু সময় করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। রাস্তার পাশের টং দোকান থেকে একটি খিলি পান কিনে নিয়ে মুখে পুরে তা চাবাতে চাবাতে মাছ বাজারের দিকে এগুতে থাকেন তিনি।
বাজারে আজ খুব ভীড়। সবাই কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। সুরুজ মিয়া এদিকওদিক ভালো করে তাকিয়ে নিলেন। শুক্রবার বলে কথা। বাজারে লোকে লোকারন্য। কিন্তু এত মানুষ দেখেও সুরুজ মিয়ার মন ভরেনি। সে বিড়বিড় করে বলতে থাকে- বাজারে এতো মানুষ! কিন্তু কাউকে দিয়ে আমার সুবিধা হবে বলে মোটেও মনে হচ্ছে না। বাজারের বেশিরভাগ ক্রেতাই গার্মেন্টস কর্মী। এদের পকেট মেরে তেমন সুবিধা হবে না। হঠাৎ গোসত দোকানের দিকে চোখ পড়লো তার। সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটাকে দেখে খুশিমনে এগিয়ে আসে সে।
কাছে এসে লোকটার মুখের দিকে তাকাতেই আবার তার মন খারাপ হয়ে গেলো।
বাজারের মসজিদের বড় হুজুর তিনি। পুরো এলাকার মানুষ তার অন্ধ ভক্ত। সবাই তাঁকে মন থেকে শ্রদ্ধা করে। কারোর একটু অসুখ-বিসুখ হলে ডাক্তারের কাছে গিয়ে ব্যর্থ হলেও হুজুরের কাছে গেলে কাজ হয়ে যায়। সুরুজ মিয়া মনে মনে ভাবতে লাগলো – এ মুহূর্তে কী করা যায়! হুজুরের পকেট মারা ঠিক হবে না। কিন্তু আর সুবিধার লোক তো দেখছি না। ওদিকে মেয়েটাও যেভাবে গোসতের জন্য কান্না করেছে। তাতে গোসত না নিয়ে বাসায়ও কেমন করে যাই!
এইসব ভাবতে ভাবতে আস্তে করে হুজুরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সুযোগ খুঁজতে লাগলেন। হুজুর যখন গোসতের দাম জিজ্ঞেস করছেন এমন সময় আলতোভাবে হুজুরের পাঞ্জাবির পকেট থেকে টাকা নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে আসে সে। হুজুর গোসত বিক্রেতাকে দুই কেজি গোসত মেপে দিতে বললেন।
গোসত ব্যাগে বুঝে নিয়ে পকেটে হাত দিয়ে বড় হুজুর লজ্জার মধ্যে পড়ে যান। সবাই হুজুরের দিকে তাকিয়ে আছেন। সুরুজ মিয়াও। মুহূর্তে বড় হুজুরের মুখখানা মলিন হয়ে গেলো। তিনি গোসত বিক্রেতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– ভাই, গোসত রেখে দিন। এখন নিতে পারছি না।
– কি হয়েছে, হুজুর?
– না, মানে ইয়ে বাসা থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে বের হয়েছিলাম। এখন দেখছি পকেটে কোন টাকা নেই। মনে হয় কোথাও পড়ে গেছে। থাক, গোসত পরে নেবো।
গোসত বিক্রেতা আগ্রহী গলায় বলল,
– হুজুর, আপনি গোসত নিয়ে যান। আমাকে পরে টাকা দিলে হবে।
বড় হুজুর ইতস্তত করে বললেন,
– না, আমি বাসা থেকে আসছি। টাকা দিয়েই গোসত নিয়ে যাবো। আপনি এগুলো আপনার পাশে রাখুন।
এই কথা বলে বড় হুজুর বাসার দিকে চলে গেলেন।
সুরুজ মিয়া মনে মনে খুশি হলেন। এরপর গোসত বিক্রেতার কাছ থেকে দুই কেজি গরুর গোসত কিনে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
বাবার হাতে গোসত দেখে সুরুজ মিয়ার ছোট্টমেয়ে মিলির সে কী আনন্দ! সে নিজের হাতে করে তা মায়ের কাছে নিয়ে যায়। মেয়েকে এমন খুশিতে থাকতে দেখে বাবামায়ের মন ভরে যায়।
সুরুজ মিয়ার স্ত্রী, সানজিদা আক্তার গোসত কুটে নিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে চুলোয় বসিয়ে দিলেন। এই সুযোগে সুরুজ মিয়া আবার বাজারে গিয়ে লেবু কিনে আনলেন। সানজিদা আক্তার গোসতের পাতিলে বারবার দেখছেন। কিন্তু গোসত চুলোয় যেমন দিয়েছেন তেমনই আছে। প্রায় একটা সময় অতিবাহিত হলো। গোসত নরম হচ্ছে না। এমন কান্ড দেখে সানজিদা আক্তার চিন্তিত হয়ে পড়লেন। চুলোর আগুনও ঠিকমতো জ্বলছে। কিন্তু গোসত সিদ্ধ হচ্ছে না। এভাবে আরো আধা ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হলো। সুরুজ মিয়া স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– কি ব্যাপার? আর কত সময় লাগবে? গোসত রাঁধতে কি এতো সময় লাগে?
সানজিদা আক্তার স্বামীকে কাছে ডেকে বললেন,
– আজ তুমি কার পকেট মেরেছো?
– কেন কি হয়েছে?
– কি হয়নি তা বলো?
– এতো প্যাচাল না করে যা বলার সরাসরি বলো।
– বলি কি তুমি দ্বিতীয়বার বাজারে যাবার সময় চুলোয় গোসত তুলেছি। এখন পর্যন্ত দেড় ঘন্টার মতো সময় অতিবাহিত হলো। কিন্তু দেখো গোসত চুলোয় যেমন দিয়েছি তেমনই আছে। একটুও সিদ্ধ হচ্ছে না। আমার মন বলছে- আজ তুমি কোন ভালো মানুষের পকেট মেরেছো। হয়তো তার বদদোয়ায় এমনটি হচ্ছে।
সুরুজ মিয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো।
সানজিদা আক্তার আবার বললেন,
– কি হলো কথা বলছো না যে?
এবার সুরুজ মিয়া আর্দ্র গলায় বললেন,
– তুমি ঠিকই ধরেছো, সানজু। আজ বাজারে তেমন সুবিধার লোক পাইনি। আমাদের বাজারের মসজিদের বড় হুজুরকে দেখছিলাম গোসত কিনছেন। অমনি উনার পকেট মেরে দিয়েছি।
– একি কথা বলছো?
– হ্যাঁ, শুধু তাই নয়। গোসত বিক্রেতার অনুরোধ সত্ত্বেও পকেটে টাকা ছিল না বলে বড় হুজুর গোসতও নেননি।
– তুমি বড় অন্যায় করেছে, মিলির বাপ। মানুষের পকেট মারা একটি খারাপ কাজ। তাই বলে বড় হুজুরের পকেটও মারতে হবে? তুমি এখনই হুজুরের কাছে যাও। হাতেপায়ে ধরে ক্ষমা চাও। নইলে আমাদের আরো বিপদ হতে পারে।
– হ্যাঁ, সানজু তুমি ঠিক কথা বলেছো। আমি এখনই বড় হুজুরের কাছে যাচ্ছি।
এই কথা বলে সুরুজ মিয়া ঘর থেকে বের হন।
দুপুরের খাবার খেয়ে বড় হুজুর একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হঠাৎ সুরুজ মিয়াকে পেরেশানি হয়ে আসতে দেখে শুয়া থেকে উঠে বসলেন। সুরুজ মিয়া বড় হুজুরের পা ধরে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলেন,
– হুজুর, আমায় মাফ করে দিন। আমি ভুল করেছি। এমন কাজ আমি আর কখনও করব না।
বড় হুজুর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– সুরুজ মিয়া, তোমার কি হয়েছে? তুমি কি এমন কাজ করেছো যে এমন আচরণ করছো?
– হুজুর, আজ সকালে বাসা থেকে বের হবার সময় আমার মেয়ে মিলি গরুর গোসত খাবে বলে বায়না ধরেছিল। কিন্তু আমার কাছে তখনও কোন টাকা ছিল না। আমি আগে থেকেই মানুষের পকেট মারতাম। আজ বাজারে আপনি ছাড়া তেমন সুবিধার কাউকে না পেয়ে আমি আপনার পকেট মেরে দিয়েছি। তারপর সেই টাকা দিয়ে দুই কেজি গরুর গোসত নিয়ে বাসায় চলে যাই। গোসত দেখে আমার মিলির সে কী আনন্দ! আমার স্ত্রী সেই গোসত চুলোয় তুলে দেবার প্রায় দেড় ঘন্টা পরও গোসত সিদ্ধ হয়নি। আমি বুঝতে পেরেছি আপনার পকেট মারা আমার একদম ঠিক হয়নি। হুজুর, আপনি আমাকে মাফ করে দিন। গোসত কেনার পর আমার কাছে আরও আটশ টাকা আছে। এই টাকাগুলো নিন, হুজুর। বাকি টাকা আমি আগামী মাসে আপনাকে দিয়ে যাবো।
বড় হুজুর তাকে জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে বললেন,
– সুরুজ মিয়া, মানুষের পকেট মারা খুব খারাপ কাজ। এটা যে তুমি যে বুঝতে পেরেছো তার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। আমি তোমাকে কোন বদদোয়া না দিলেও তোমার কথায় মনে হচ্ছে তা লেগে গেছে। এমন অনেক মানুষ আছে যাদের খুব কষ্টের টাকা তোমরা পকেট মেরে দাও। তাদের বদদোয়া লাগলে জীবনে যতোই চেষ্টা করো সফল হবে না। শুধু দৌড়ের ওপর থাকবে। আমি বলছি, এই টাকা তুমি তোমার কাছে রেখে দাও। আর হ্যাঁ, আগামিকাল এসে আমার কাছ থেকে আরো কিছু টাকা নিয়ে যাবে। তুমি প্রয়োজনে ছোট্ট করে একটি পানের দোকান দাও। দেখবে ব্যবসা তোমার জীবন পাল্টে দেবে। মনে রেখো হারামে আরাম নেই।
সুরুজ মিয়া বড় হুজুরের মুখের দিকে অবুঝ বালকের মতো তাকিয়ে রইলেন।